পল্লীগীতি গান আব্দুল আলীমের
নজরুলগীতির কিংবদন্তি শিল্পী আব্দুল আলীমের লোকসঙ্গীত
🎭 বাংলার লোকগীতির অমর কণ্ঠশিল্পী (১৯২৭-১৯৭৪)
ভূমিকা
আব্দুল আলীম (১৯২৭-১৯৭৪) ছিলেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লোকসঙ্গীত শিল্পী। তিনি মূলত নজরুলগীতির জন্য বিখ্যাত হলেও পল্লীগীতি গান আব্দুল আলীমের অবদান বাংলার লোকসঙ্গীতের ইতিহাসে অমূল্য। তার কণ্ঠে বাউল, ভাটিয়ালী, মুর্শিদি ও গ্রামীণ গানের যে মাধুর্য ফুটে উঠত, তা আজও মানুষের হৃদয়ে অমলিন।
আব্দুল আলীম মুর্শিদাবাদের লালগোলা থানার চাষাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আজিম উদ্দিন সরকার ছিলেন একজন গ্রামীণ সঙ্গীতশিল্পী। পারিবারিক পরিবেশেই তার সঙ্গীতচর্চার শুরু। এই গ্রামীণ পরিবেশ তার লোকসঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলার লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে আব্দুল আলীমের অবদান অপরিসীম। তিনি শুধুমাত্র একজন গায়ক ছিলেন না, বরং লোকসংস্কৃতির একজন অবিরাম প্রচারক ও সংরক্ষক ছিলেন। তার কণ্ঠে গ্রামবাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহের যে চিত্র ফুটে উঠত, তা শুধু শিল্প নয়, ছিল জীবনের প্রতিফলন।
আব্দুল আলীমের বিস্তারিত জীবনী
🏠 জন্ম ও শৈশবকাল
আব্দুল আলীম ১৯২৭ সালের ১৫ মার্চ মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার চাষাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আজিম উদ্দিন সরকার একজন স্থানীয় লোকশিল্পী ছিলেন যিনি গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতেন। মাতা সৈয়দা খাতুন ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ গৃহিণী।
শৈশবেই আব্দুল আলীমের সঙ্গীতপ্রতিভা প্রকাশ পায়। গ্রামের নদীর ধারে বসে তিনি প্রকৃতির সুরে গান গাইতেন। স্থানীয় পালাগান ও যাত্রার আসরে তার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। পিতার কাছেই প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন।
🎓 সঙ্গীত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
আব্দুল আলীম কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত উস্তাদ আজিজুল হক, উস্তাদ জমিরুদ্দিন খান ও উস্তাদ ওয়াজেদ আলী খানের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন। তিনি ঠুমরি, গজল, কাওয়ালি এবং ধ্রুপদী সঙ্গীতে দক্ষতা অর্জন করেন।
একই সময়ে তিনি লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা যেমন বাউল, ভাটিয়ালী, মুর্শিদি, মারফতি ইত্যাদি শেখেন। তার গুরুদের মধ্যে কবি নজরুল ইসলামের প্রভাব ছিল গভীর। নজরুলের গানের পাশাপাশি তিনি লোকগীতির চর্চা অব্যাহত রাখেন।
🎤 কর্মজীবন ও সাফল্য
১৯৫০-এর দশকে আব্দুল আলীম আকাশবাণী কলকাতা থেকে নিয়মিত গান পরিবেশন শুরু করেন। তার কণ্ঠে নজরুলগীতি ও লোকসঙ্গীত অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষত ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে’ গানটি তাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলে।
১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫০০টিরও বেশি গান রেকর্ড করেন। এর মধ্যে প্রায় ১৫০টি ছিল খাঁটি লোকসঙ্গীত। তার গাওয়া ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, ‘ও নদী রে’, ‘মুর্শিদ ধ্যান দাও আমায়’ এই গানগুলো আজও সমানভাবে জনপ্রিয়।
আব্দুল আলীম শুধু স্টুডিওতে গান রেকর্ড করতেন না, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে লাইভ পারফরম্যান্স করতেন। তার কনসার্টে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি থাকত। বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে।
🏆 স্বীকৃতি ও সম্মাননা
আব্দুল আলীম তার জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি নজরুল সংগীত সম্মাননা (১৯৬৮), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭০), এবং পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। স্বাধীন বাংলাদেশেও তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদক প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহান শিল্পীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তিনি আরও বেশি সম্মানিত হন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে তার নামে রাস্তা, সঙ্গীত একাডেমি এবং স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
আব্দুল আলীমের বিখ্যাত পল্লীগীতি সংগ্রহ
ক্রম | গানের নাম | ধরন | রেকর্ড সাল | বিশেষত্ব |
---|---|---|---|---|
১ | কেন পিরিতি বাড়াইলা রে | নজরুলগীতি | ১৯৫৫ | সর্বাধিক জনপ্রিয় |
২ | ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে | নজরুলগীতি | ১৯৫৬ | ধর্মীয় ভাবগাঁথা |
৩ | আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে | বাউল | ১৯৫৮ | আধ্যাত্মিক দর্শন |
৪ | মুর্শিদ ধ্যান দাও আমায় | মুর্শিদি | ১৯৫৯ | সুফি ঐতিহ্য |
৫ | আল্লাহর নামে শুরু করি | হামদ | ১৯৬০ | আল্লাহর প্রশংসা |
৬ | তুমি যে আমার কবিতা | গজল | ১৯৬১ | প্রেমের গান |
৭ | ও নদী রে | ভাটিয়ালী | ১৯৬২ | নদীর গান |
৮ | আমি কোন্ সুখে জগতে এসেছি | বাউল | ১৯৬৩ | জীবন দর্শন |
৯ | জীবনে যা পেয়েছি | নজরুলগীতি | ১৯৬ৄ | জীবনের উপলব্ধি |
১০ | আল্লাহ মেঘ দে পানি দে | কৃষাণ গীত | ১৯৬৫ | কৃষক জীবন |
১১ | গাঙের কূলে কূলে | ভাটিয়ালী | ১৯৬৬ | নৌকার গান |
১২ | এ কী লাবণ্যে ভরা প্রাণে | নজরুলগীতি | ১৯৬৭ | প্রকৃতির মাধুর্য |
১৩ | ভোরের পাখি গান গেয়ে যায় | পল্লীগীতি | ১৯৬৮ | প্রভাতী গান |
১৪ | সখি ভাবনা কাহারে বলে | বাউল | ১৯৬৯ | মনের কথা |
১৫ | আমার সোনার বাংলা | দেশাত্মবোধক | ১৯৭০ | স্বাধীনতার গান |
১৬ | পদ্মা নদীর মাঝি | ভাটিয়ালী | ১৯৭১ | মাঝির জীবন |
১৭ | শেষ বিকেলের আলো | পল্লীগীতি | ১৯৭২ | সন্ধ্যার গান |
১৮ | মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে | বাউল | ১৯৭৩ | মনের নৌকা |
১৯ | রাঙা প্রভাতে | উদীচী | ১৯৭৪ | শেষ রেকর্ড |
২০ | ধন্যি মেয়ে তোর | লোকগীতি | Posthumous | মরণোত্তর প্রকাশ |
🎨 সঙ্গীত শৈলী ও অবদান
🎵 সঙ্গীত শৈলীর বৈশিষ্ট্য
কণ্ঠস্বরের বৈশিষ্ট্য
আব্দুল আলীমের কণ্ঠস্বর ছিল গভীর, মধুর ও আবেগ প্রবণ। তার গলায় ছিল প্রাকৃতিক কম্পন যা লোকসঙ্গীতের জন্য উপযুক্ত।
তালের দক্ষতা
বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের তাল যেমন দাদরা, কাহার বা, ঝুমুর ইত্যাদিতে তার ছিল অসাধারণ দক্ষতা।
আব্দুল আলীমের গানের বিশেষত্ব ছিল তার আবেগপ্রবণতা ও সহজ-সরল উপস্থাপনা। তিনি জটিল রাগ-রাগিণীর পরিবর্তে সহজ সুরে গান গাইতেন যা সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য ছিল। তার কণ্ঠে গ্রামবাংলার মাটির গন্ধ ছিল।
🌟 বাংলা সঙ্গীতে অবদান
- লোকসঙ্গীতের জনপ্রিয়করণ: শহুরে শিক্ষিত সমাজে লোকসঙ্গীতের প্রসার ঘটান।
- নজরুল সঙ্গীতের নতুন মাত্রা: নজরুলের গানে লোকসঙ্গীতের ছোঁয়া যোগ করেন।
- আঞ্চলিক গানের সংরক্ষণ: বিভিন্ন অঞ্চলের লুপ্তপ্রায় গান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন।
- নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা: আধুনিক শিল্পীদের লোকসঙ্গীত চর্চায় অনুপ্রাণিত করেন।
🌟 সাংস্কৃতিক প্রভাব ও উত্তরাধিকার
আব্দুল আলীমের পল্লীগীতি গান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার কণ্ঠে গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার যে চিত্র ফুটে উঠত, তা আজও নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন বাংলার লোকসংস্কৃতির একজন অগ্রদূত।
তার গাওয়া লোকসঙ্গীত শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, বরং বাংলার মানুষের জীবনদর্শন ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ছিল। আজকের দিনেও তার গান গ্রাম-শহরের মানুষের হৃদয়ে একইভাবে অনুরণিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার দেশাত্মবোধক গান মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে।
আধুনিক যুগে প্রভাব
বর্তমান সময়ের অনেক শিল্পী আব্দুল আলীমের গান পুনরায় গেয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। তার গানের ভিডিও ইউটিউবে লাখো মানুষ দেখেন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তার গানের অনুষ্ঠান নিয়মিত প্রচারিত হয়।
আব্দুল আলীমের সঙ্গীত শুধু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের যেখানেই বাঙালি কমিউনিটি রয়েছে, সেখানে তার গান সমানভাবে জনপ্রিয়। তার সঙ্গীতের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে লোকসঙ্গীত কখনো পুরাতন হয় না, বরং সময়ের সাথে সাথে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
🎵 আব্দুল আলীমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা – বাংলার লোকসঙ্গীতের অমর কণ্ঠশিল্পী
© ২০২৪ – পল্লীগীতি গান আব্দুল আলীমের | বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য