বনলতা সেন কবিতা লিরিক্স: জীবনানন্দ দাশের অমর সৃষ্টি
কবি: জীবনানন্দ দাশ | প্রকাশকাল: ১৯৪২ | কাব্যগ্রন্থ: বনলতা সেন

সূচিপত্র
ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জীবনানন্দ দাশের “বনলতা সেন” একটি যুগান্তকারী কবিতা। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত এই কবিতা রূপকথার নায়িকা সদৃশ এক মহিলার কল্পনা নিয়ে রচিত, যা বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত। জীবনানন্দ দাশের রূপময় কল্পনাশক্তি, গভীর ভাষা-চিত্রকল্প, এবং প্রতীকী ব্যঞ্জনা এই কবিতাকে অনন্য করে তুলেছে।
“বনলতা সেন” এমন একটি কবিতা যা পাঠকদের একটি চিরন্তন সৌন্দর্য ও প্রশান্তির জগতে নিয়ে যায়। কবিতাটিতে নাটোরের বনলতা সেন নামক এক রমণীর কথা বলা হয়েছে, যিনি অদ্ভুতভাবে শান্তিদায়ক, প্রশান্তিপূর্ণ এবং কবি-জীবনে নির্বাণস্বরূপ। এই কবিতাটি শুধু একটি নারীর সৌন্দর্যের বর্ণনা নয়, বরং মানবজীবনের ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতা এবং জীবনের শেষে এক চিরন্তন শান্তির সন্ধানের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়।

সম্পূর্ণ কবিতা: বনলতা সেন কবিতা লিরিক্স
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
কবিতার নাম: বনলতা সেন
কবি: জীবনানন্দ দাশ
প্রকাশকাল: ১৯৪২
কাব্যগ্রন্থ: বনলতা সেন
কবিতার বিশ্লেষণ
“বনলতা সেন” কবিতাটি শুধু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনাই নয়, বরং বিশ্ব সাহিত্যেও এর স্বীকৃতি রয়েছে। নিম্নে এই অমর কবিতাটির বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হল:
মূলভাব
কবিতার মূলভাব হল মানুষের জীবনের ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতা এবং শেষ পর্যন্ত শান্তি ও নির্বাণের সন্ধান। কবি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, এবং সেই ক্লান্তির অবসান ঘটাতে আসেন নাটোরের বনলতা সেন, যিনি শান্তি ও প্রশান্তির প্রতীক।
রূপকল্প ও প্রতীক
কবিতাটিতে অসংখ্য রূপকল্প ও প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা” – এখানে বনলতা সেনের চুলকে প্রাচীন ভারতের বিদিশা নগরীর অন্ধকার রাত্রির সাথে তুলনা করা হয়েছে। “পাখির নীড়ের মত চোখ” – এই উপমা বনলতা সেনের চোখের নিরাপদ, আশ্রয়দাতা স্বভাবকে নির্দেশ করে।
সময় ও ইতিহাসের মিশ্রণ
জীবনানন্দ এই কবিতায় সময়ের সীমানা অতিক্রম করেছেন। তিনি বিম্বিসার, অশোক, বিদর্ভ, শ্রাবস্তী – এই প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার উল্লেখ করেছেন, যা কবিতাকে এক চিরন্তন মাত্রা দিয়েছে। কবির ভ্রমণ শুধু ভৌগোলিক নয়, ঐতিহাসিকও।
নারী রূপের অনন্য চিত্রায়ণ
কবি বনলতা সেনের রূপ বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত অনন্য পদ্ধতিতে। তিনি প্রচলিত সৌন্দর্যের বর্ণনা থেকে বেরিয়ে এসে প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকর্ম, প্রাকৃতিক উপমা এবং শান্তিদায়ক ভাবগম্ভীর চরিত্র হিসেবে বনলতা সেনকে উপস্থাপন করেছেন।
নির্বাণের আকাঙ্ক্ষা
কবিতার শেষে “থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন” – এই লাইনটি প্রশান্তি, শান্তি ও নির্বাণের সূচক। সমস্ত দিনের শেষে, সমস্ত ব্যস্ততার শেষে, জীবনের সমস্ত লেনদেন শেষ করে, শুধু থাকে চিরন্তন শান্তি – যা বনলতা সেনের মাধ্যমে প্রতীকায়িত।
ভাষা ও ছন্দ
কবিতাটি দীর্ঘ ছন্দে রচিত, যা একই সাথে সঙ্গীতময় এবং গম্ভীর আবহ সৃষ্টি করে। প্রতিটি স্তবকের শেষে “বনলতা সেন” উল্লেখ করে কবিতার একটি লয়ধর্মী কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। চিত্রকল্প সমৃদ্ধ ভাষা কবিতার অর্থকে গভীরতর করেছে।
ইংরেজি অনুবাদ “বনলতা সেন কবিতা লিরিক্স”
Banalata Sen
For thousands of years I have been walking the paths of this earth,
From the seas of Ceylon to the Malayan seas in the darkness of night
I have traveled; in the dim world of Bimbisara and Ashoka
I have been there; even further, in the darkness of the city of Vidarbha;
I am a weary soul, with the foaming sea of life all around me,
To me she gave a moment’s peace – Banalata Sen from Natore.
Her hair was like the ancient darkness of Vidisha,
Her face, the craftsmanship of Sravasti; as the sailor,
Losing his way in a distant sea,
Sees the verdant land of grass through the cinnamon isles,
So I saw her in the darkness; she said, “Where have you been so long?”
Raising her eyes like a bird’s nest—Banalata Sen from Natore.
At the end of the day, with the sound of dew,
Evening comes; the kite wipes away the scent of sun from its wings;
When all the colors of the world fade, the manuscript prepares,
For stories, as fireflies twinkle with light;
All birds come home — all rivers — all of life’s transactions end;
Only darkness remains, and facing me, Banalata Sen.
হিন্দি অনুবাদ “বনলতা সেন কবিতা লিরিক্স”
बनलता सेन
हजारों वर्षों से मैं पृथ्वी के मार्गों पर चल रहा हूँ,
सिंहल समुद्र से लेकर मलय सागर तक रात्रि के अंधकार में
बहुत घूमा मैं; बिम्बिसार अशोक के धूसर जगत में
वहाँ था मैं; और दूर अंधकार में विदर्भ नगर में;
मैं थका प्राण एक, चारों ओर जीवन का समुद्र झागदार,
मुझे दो क्षण शांति दी थी नाटोर की बनलता सेन।
बाल उसके कब के अंधकार विदिशा की रात,
मुख उसका श्रावस्ती का कारुकार्य; अति दूर समुद्र पर
पतवार टूटने से जो नाविक खो बैठा है दिशा
हरी घास के देश जब वो देखता है दारचीनी द्वीप के भीतर,
ऐसे ही देखा उसे अंधकार में; कहा उसने, ‘इतने दिन कहाँ थे?’
पक्षी के घोंसले जैसे नेत्र उठाकर नाटोर की बनलता सेन।
सारे दिन के अंत में ओस की आवाज़ की तरह
संध्या आती है; अपने पंखों से सूरज की गंध पोंछ देता है चील;
पृथ्वी के सारे रंग धुंधले पड़ने पर पांडुलिपि करती है तैयारी
तब कहानियों के लिए जुगनू के रंग से झिलमिलाहट;
सभी पक्षी घर आते हैं — सभी नदियाँ — इस जीवन के सभी लेनदेन खत्म होते हैं;
रह जाता है केवल अंधकार, आमने-सामने बैठने को बनलता सेन।
কবি জীবনানন্দ দাশের পরিচিতি
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)
জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ এবং ‘রূপসী বাংলা’র কবি হিসেবে পরিচিত। বরিশালে জন্মগ্রহণ করা এই কবি বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে স্বীকৃত। ১৯২৯ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, এবং জীবনবোধের এক অনন্য সমন্বয় দেখা যায়। তাঁর রূপকল্প, চিত্রকল্প, এবং প্রতীকী ব্যবহার বাংলা কবিতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তিনি ছিলেন ‘কল্লোল যুগ’-এর উল্লেখযোগ্য কবি এবং তাঁর রূপকল্পময় ভাষা ও প্রতীকী ব্যবহারের জন্য ‘অস্পষ্ট কবি’ বা ‘নির্জনতম কবি’ হিসেবেও পরিচিত।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘রূপসী বাংলা’ ইত্যাদি। ১৯৫৪ সালের ২২শে অক্টোবর কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কবির মৃত্যু হয়।
বনলতা সেন নামকরণের সার্থকতা
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার জন্য “বনলতা সেন” নামকরণ অত্যন্ত সার্থক হয়েছে। এই নামে রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির গভীর স্পর্শ, কারণ ‘বন’ শব্দটি প্রকৃতি এবং সবুজের প্রতীক, ‘লতা’ শব্দটি সৌন্দর্য ও কোমলতার প্রতিনিধিত্ব করে, আর ‘সেন’ হল একটি বাঙালি পদবি যা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত।
বনলতা সেন নাম নিজেই একটি চিত্রকল্প তৈরি করে – প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কোমলতা, এবং চিরন্তন বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বিত প্রতীক। কবি নাটোরকে বনলতা সেনের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন, কারণ নাটোর ছিল প্রাচীন বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এই নামকরণ কবিতার ভাবগত দিক এবং রূপকল্পের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।
নামটি শুধু একটি ব্যক্তির পরিচায়ক নয়, এটি একটি প্রতীক, একটি আবহ, এবং একটি দর্শন – শান্তি, নিরাপত্তা, এবং নির্বাণের দর্শন।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, যদিও কবিতাটি তার নাম থেকেই “বনলতা সেন” নামে পরিচিত, কিন্তু আসলে এটি কবিতার শিরোনাম নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নাম। কবিতার প্রতিটি স্তবকের শেষে “বনলতা সেন” নামটি পুনরাবৃত্তি হয়, যা কবিতাটিকে একটি মন্ত্রোচ্চারণ বা প্রার্থনার মতো শোনায়।
সাহিত্যিক গুরুত্ব ও প্রভাব
“বনলতা সেন” শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। এই কবিতা আধুনিক বাংলা কবিতার গতিধারাকে নতুন পথে পরিচালিত করেছে। কবিতাটি বিশ্বব্যাপী অনুদিত হয়েছে এবং বিভিন্ন ভাষার পাঠকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
বাংলা সাহিত্যে প্রভাব
বাংলা সাহিত্যে “বনলতা সেন” একটি মাইলফলক। এই কবিতার পরে লেখা বাংলা কবিতাগুলিতে জীবনানন্দের রূপকল্পের প্রভাব অনুধাবন করা যায়। বিশেষ করে তাঁর চিত্রকল্পময় ভাষা এবং প্রতীকী ব্যবহার পরবর্তী কবিদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
প্রেমের কবিতা হিসেবে
যদিও সরাসরি প্রেমের উল্লেখ নেই, তবুও “বনলতা সেন” বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা হিসেবে বিবেচিত। এই প্রেম কোনও সাধারণ প্রেম নয়, এটি জীবনের ক্লান্তি ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় এমন এক শান্তি ও নির্বাণের প্রতি ভালোবাসা।
সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ
কবিতাটি বাংলা সংস্কৃতির সাথে-সাথে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার উল্লেখ করে একটি বিশাল সাংস্কৃতিক ক্যানভাস তৈরি করেছে। সিংহল (শ্রীলঙ্কা), মালয় (মালয়েশিয়া), বিম্বিসার, অশোক, বিদর্ভ, শ্রাবস্তী – এই উল্লেখগুলি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে।
চিরন্তন সৌন্দর্য
নারী সৌন্দর্যের বর্ণনায় জীবনানন্দ পারম্পরিক ধারণাকে অতিক্রম করেছেন। বনলতা সেনের সৌন্দর্য শুধু দৈহিক নয়, তা আধ্যাত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। এই সৌন্দর্য কালজয়ী এবং চিরন্তন – যেমন তিনি বর্ণনা করেছেন “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা”।
কবিতার আবৃত্তি
জীবনানন্দ দাশের “বনলতা সেন” কবিতাটি বিভিন্ন আবৃত্তিকারের কণ্ঠে নতুন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এই কবিতাটির সুমধুর আবৃত্তি শুনতে নিচের ভিডিওটি দেখুন:
ভিডিও ক্রেডিট: বাংলা সাহিত্য আর্কাইভ
ট্যাগ সমূহ
বনলতা সেন কবিতা
বনলতা সেন কবিতা লিরিক্স
জীবনানন্দ দাশ
নাটোরের বনলতা সেন
বনলতা সেন কবিতার মূলভাব
বাংলা কবিতা
বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ
বাংলা প্রেমের কবিতা