সেরা ১০ রবীন্দ্র সংগীত লিরিক্স: ঠাকুরের অমর বাণীর খোঁজে

লেখক: রবীন্দ্র অনুরাগী | প্রকাশ: এপ্রিল ২০, ২০২৫
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বাংলা সাহিত্যের ই নন, বিশ্ব সাহিত্যেরও এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর সৃষ্ট রবীন্দ্র সংগীত আজও আমাদের হৃদয়ে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এই অমর সুরকার, কবি ও দার্শনিকের লেখা সংগীতগুলি আধুনিক যুগেও প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের চিন্তাধারাকে নতুন দিশা দেখায়। আজ আমরা আলোচনা করব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা ১০টি সংগীতের লিরিক্স, যেগুলি শতাব্দী পেরিয়েও আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। প্রতিটি সংগীতের মূল লিরিক্স, তার অনুবাদ এবং সেই সংগীত রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।”
“
একলা চলো রে
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে॥
যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে—
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে॥
অনুবাদ:
If no one responds to your call, then go your own way alone.
Go alone, go alone, go alone, go on your way alone.
If no one speaks to you, O unlucky one,
If everyone turns their face away, everyone is afraid—
Then with your heart wide open,
You speak your mind aloud.
If everyone turns back, O unlucky one,
If at the time of taking the difficult path, no one looks back—
Then the thorns on the path,
Trample them alone with blood-soaked feet.
If no one holds the light, O unlucky one,
If in the stormy dark night, the doors are shut—
Then with the thunderbolt,
Light the ribs of your chest, burn alone.
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘একলা চলো রে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম জনপ্রিয় এবং প্রেরণাদায়ক গান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় এই গানটি রচিত হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এটি দেশপ্রেমিকদের অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সত্যের পথে একাকী চলার সাহস জোগানোর জন্য এই গানটি আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
এই গানটি মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় সংগীতগুলির মধ্যে একটি ছিল। তিনি বলতেন, “এই গানটি আমাকে সবচেয়ে কঠিন সময়েও সাহস জুগিয়েছে।”
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: পূজা পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯০৫ সাল - ♪
প্রথম প্রকাশ: স্বদেশ সংকলন
আগুনের পরশমণি
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে॥
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো তোমার যজ্ঞে,
আলোক-শিখায় প্রদীপ্ত করো,
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে॥
তাপে তাপে জারিত করো, কণ্টকে বিদীর্ণ করো,
নিখিল বেদনা-মাঝে আবির্ভাব তব হোক,
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে॥
দূর করো সব আবরণ, সহজে করো দরশন,
আমার এ-দেহ তোমারি হোক,
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে॥
অনুবাদ:
Touch my soul with the philosopher’s stone of fire,
Make this life sacred with the gift of burning.
Lift this body of mine in your sacrifice,
Make it radiant with the flame of light,
Make this life sacred with the gift of burning.
Purify it with heat, pierce it with thorns,
May you emerge amidst all pain,
Make this life sacred with the gift of burning.
Remove all veils, make the vision easy,
Let this body be yours,
Make this life sacred with the gift of burning.
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘আগুনের পরশমণি’ একটি আধ্যাত্মিক গান যা রবীন্দ্রনাথের গভীর ঈশ্বর প্রেমকে প্রকাশ করে। এই গানে কবি আত্মশুদ্ধি, আত্মত্যাগ এবং ঈশ্বরের সাথে একাত্মতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। গানটিতে অগ্নিকে শুদ্ধির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ এই গানে রূপক হিসেবে আগুনকে ব্যবহার করেছেন – যেমন পরশমণি ছুঁয়ে লোহাকে সোনায় পরিণত করে, তেমনি ঈশ্বরের প্রেমরূপী অগ্নি মানুষের চেতনাকে শুদ্ধ করে।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: পূজা পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯১৪ সাল - ♪
রাগ: ভৈরবী - ♪
তাল: ঝাঁপতাল
আমার সোনার বাংলা
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে
বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে,
নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে
লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে,
আমি নয়নজলে ভাসি॥
অনুবাদ:
My golden Bengal, I love you.
Forever your skies, your air, plays flute in my heart.
O mother, in spring, your mango groves
Drive me crazy with their fragrance,
Oh my, oh my!
O mother, in autumn, your bountiful fields,
I have seen what a sweet smile!
What beauty, what shade, what love, what affection,
What a quilt have you spread at the feet of banyan trees
And along the banks of rivers.
Mother, the words from your lips are like nectar to my ears,
Oh my, oh my!
Mother, if your face turns sad,
I bathe in tears.
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘আমার সোনার বাংলা’ সংগীতটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও আবেগ প্রকাশ করতে এই গানটি রচনা করেছিলেন।
এই গানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাঙালীর জীবনযাপন, বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য এবং দেশমাতৃকার প্রতি একজন সন্তানের গভীর ভালোবাসা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: স্বদেশ পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯০৫ সাল - ♪
জাতীয় সংগীত: বাংলাদেশ - ♪
প্রথম গীত: ১১ মার্চ ১৯০৫
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর।
সঙ্গে তব লব আজি মোরে, ছিনায়ে লও সংশয় ভার
ছিঁড়ায়ে লও বন্ধন ডোর॥
নিবিড় তিমিরে ঘেরে যবে বিশ্ব চরাচর
আলোক-প্রদীপ হাতে তব উদয় হও হে,
নিখিল ভুবন-পর॥
যবে ঘটে ধরাতলে অনাচার অত্যাচার
বিলাও হে তব করুণাধার অমিয় অমর॥
যবে মরি আমি, ভুলি আমি,
কঠিন অহংকার-বেড়ি দিয়ে ভবে আসি,
মোহনিশা বিনাশিতে
জাগাও হে হৃদয়-মাঝে চিরজাগরূক
সাধনার মন্ত্র স্বর॥
অনুবাদ:
In the realm of joy, in the realm of prosperity, dwells truth and beauty.
Take me with you today, remove the burden of doubt,
Break the bonds that tie me down.
When dense darkness surrounds the entire universe,
With the lamp of light in your hand, rise, O Lord,
Above the entire world.
When injustice and oppression occur on earth,
Bestow your fountain of compassion, immortal nectar.
When I die, when I forget,
When I come to the world with the hard shackles of ego,
To destroy the night of delusion,
Awaken in my heart the ever-vigilant
Mantra voice of spiritual practice.
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটি রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের একটি বিখ্যাত রচনা। এটি ১৯৪১ সালে রচিত হয়। এই সংগীতে কবি ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ এবং বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছেন।
এই গানে রবীন্দ্রনাথ সত্য এবং সুন্দরের রাজ্যে প্রবেশের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যেখানে কোনো অনাচার বা অত্যাচার নেই। তিনি ঈশ্বরের কাছে অহংকার ও মোহ থেকে মুক্তি এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: পূজা পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯৪১ সাল - ♪
রাগ: যমন কল্যাণ - ♪
তাল: দাদরা
পুরানো সেই দিনের কথা
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়,
ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা কি ভোলা যায়॥
আমি কোন্ সকালে খেলি নাই তোর সনে খেলা,
আমি কোন্ সকালে করি নাই কত ছেলেমেলা,
আমি কোন্ সকালে ভাসি নাই সুখসাগরে হায়॥
এমন দিন কি আর হবে বলবি কি রে ভাই,
এমন করে দুজনে মিলে গাইবি কি গান হায়,
আমি কোন্ ডালে ফুল তুলি নাই চুলে ফুল দিতে,
আমি কোন্ গায়ে বেড়াই নাই পাখি ধরিবারে,
আমি কোন্ সকালে চাই নাই তোর মুখপানে হায়॥
অনুবাদ:
Will you forget those old days, alas,
Those visual exchanges, heartfelt words, can they be forgotten?
On which morning did I not play games with you,
On which morning did I not enjoy childish pranks,
On which morning did I not float in an ocean of happiness, alas?
Will such days ever come again, tell me, brother,
Will we ever meet again and sing together, alas,
From which branch did I not pluck flowers to put in your hair,
In which village did I not roam to catch birds,
On which morning did I not look at your face, alas?
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অতীতের স্মৃতিচারণ করেছেন। এটি প্রেম ও বিরহ পর্যায়ের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গান, যেখানে কবি বন্ধু বা প্রিয়জনের সাথে কাটানো শৈশবের মধুর স্মৃতিগুলি স্মরণ করেছেন।
১৮৮১ সালে “মানসী” কাব্যগ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত এই গানে রবীন্দ্রনাথ মনে করিয়ে দেন যে সময় অনিবার্যভাবে এগিয়ে যায়, কিন্তু স্মৃতি চিরকাল থাকে। গানটি নস্টালজিয়া ও বিরহ দুটি অনুভূতিই সঞ্চার করে শ্রোতার মনে।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: প্রেম পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৮৮১ সাল - ♪
রাগ: পীলু - ♪
তাল: ঝাঁপতাল
যদি আমায় নাহি দাও ঠাঁই
যদি আমায় নাহি দাও ঠাঁই, ও তবে নিরাশ হবে না তো তাই,
সবার পেছে আমি রইব দাঁড়ায়ে, ও তোমার দুয়ার ছেড়ে যাব না তো তাই॥
যদি আমার কথায় না দাও উত্তর, ও তবে নিরাশ হবে না তো তাই,
চুপ করে আমি নয়ন জলে আঁধার রাতে ভরিয়ে দেব তোমার মাধুরী চাঁদের আলোয়॥
যদি পরানে দাও না আশা, ও তবে নিরাশ হবে না তো তাই,
তোমার নামের মালা গেঁথে আমি বসে আছি একা,
হয়ত আমার ভাগ্যে যদি হঠাৎ মিলে যায় তোমার দেখা॥
অনুবাদ:
If you do not give me a place, even then I will not be disappointed,
I will remain standing behind everyone, I will not leave your door.
If you do not answer my words, even then I will not be disappointed,
Silently, with tears in my eyes, in the dark night, I will fill your sweetness with moonlight.
If you do not give hope to my soul, even then I will not be disappointed,
I sit alone, having strung a garland of your name,
Perhaps in my fate, I might suddenly meet you.
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘যদি আমায় নাহি দাও ঠাঁই’ গানটি রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের একটি বিখ্যাত রচনা। এই গানে ভক্তের একনিষ্ঠ সাধনা ও ঈশ্বরের প্রতি অবিচল ভক্তির চিত্র ফুটে উঠেছে।
এই গানে কবি প্রত্যাখ্যাত হলেও নিরাশ না হয়ে ঈশ্বরের প্রতি অটল ভক্তি ও বিশ্বাস রাখার কথা বলেছেন। এটি একজন ভক্তের নিরহংকার আত্মসমর্পণের অভিব্যক্তি, যিনি ঈশ্বরের দর্শন লাভের জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত, যতক্ষণই তা না হয়।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: পূজা পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯৩৬ সাল - ♪
রাগ: খাম্বাজ - ♪
তাল: ঝাঁপতাল
আজি ঝড়ের রাতে
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসারে
বন্ধু, আমার পথ কে বারে বারে॥
ছিন্ন তরীখানি মম ব্যাকুল-তরঙ্গে ভাসে,
বারেক চাহিয়া দেখো, কারে দয়া হয় মনে॥
ওগো, বাজে কড়া খড়ম তোমার চরণে,
দূর হতে শুনি আমি এ আঁধার ভবনে॥
ধ্বনি তব যেন লয়ে মম সকল আশা
বাহির হল পথে, যে পথ-ডাক আসে না ফিরে॥
অনুবাদ:
On this stormy night, on your tryst,
Friend, who blocks my path again and again?
My torn boat floats on the anxious waves,
Look once, who feels compassion in their heart?
Oh, your wooden sandals strike hard,
I can hear from afar in this dark dwelling.
Your sound, as if taking all my hopes,
Has gone out on the path, the path-call that does not return.
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘আজি ঝড়ের রাতে’ গানটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি ঝড়ের রাতের চিত্র অঙ্কন করেছেন, যেখানে একজন ব্যক্তি তার প্রিয়জনের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য ব্যাকুল, কিন্তু বিভিন্ন বাধা তাকে বাধা দিচ্ছে।
এই গানে প্রকৃতির রূপক ব্যবহার করে আধ্যাত্মিক অভিসারের কথা বলা হয়েছে। ঝড়ে বিক্ষুব্ধ সাগরে ভাসমান ছিন্ন তরী যেন সংসারসাগরে ব্যাকুল মানবাত্মার প্রতীক, যে আপন প্রিয়তম ঈশ্বরের সাথে মিলিত হতে চায়।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: পূজা পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯২২ সাল - ♪
রাগ: বাউল - ♪
তাল: কাহারবা
তোমারেই করিয়াছি
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
তোমারেই করিয়াছি, প্রিয়ে, তোমারেই করিয়াছি॥
আমার সুরে সুরে আছ, তুমি রাগিণী বিরাজিত,
আমার নয়নে নয়নে আছ, তুমি দৃষ্টি বিস্তারিত,
আমার হৃদয়ে হৃদয়ে আছ, তুমি দিবসরজনী-ভরা–
আমার সকল সাধনে আছ, তুমি আপনি উদাসীনা॥
আমার ঘরে ঘরে আছ, তুমি বিরাহসামগ্রী-সহ,
আমার দেশে দেশে আছ, তুমি পরবাসপরিচিতা,
আমার ভাষায় ভাষায় আছ, তুমি বিদেশবাণী-খচিতা–
আমার সকল ভুবনে আছ, তুমি অপরূপরূপা॥
অনুবাদ:
I have made you the pole star of my life,
I have made you, dear, I have made you.
You are in my every melody, you pervade the musical modes,
You are in my every glance, you expand my vision,
You are in my every heartbeat, you fill my days and nights—
You are in all my devotions, you remain detached yourself.
You are in my every home, with the essentials of separation,
You are in my every land, familiar with the foreign,
You are in my every language, inlaid with foreign words—
You are in all my worlds, you of unparalleled beauty.
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটি রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও পূজা দুই পর্যায়েরই অন্তর্গত হতে পারে। এই গানে কবি প্রিয়জন বা ঈশ্বরকে তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা বা পথ প্রদর্শক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই গানে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন কিভাবে প্রিয়জন বা ঈশ্বর তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক – তাঁর সংগীত, দৃষ্টি, হৃদয়, সাধনা, ঘর, দেশ, ভাষা – সবকিছুতে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। এই গভীর উপলব্ধি ও স্বীকারোক্তি গানটিকে অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ও আধ্যাত্মিক করে তুলেছে।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: প্রেম পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯১৪ সাল - ♪
রাগ: ঝিঁঝিট - ♪
তাল: ঝাঁপতাল
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
ঘরে থাকা দায়।
ঘরে ছিলেম, হাজার কাজে
পাড়ি ঘোরে নাজে-
মন টানে মোরে যাগো যাই যাই যাই॥
আজকে আমায় যেতেই হবে,
যেতেই হবে রে।
বাঁচতে যে চাই, মরতে যে চাই,
কেদে যে যাই নে মোরে-
সাথি আমার যেতেই হবে রে॥
ওরে পাগলা বাতাস আজ,
কি এনেছিস মোদের মাঝে?
ও কি মনে জাগায় যে এই বাদল
জলধারায়,
চোখের জলে কেন ভিজি যাই॥
অনুবাদ:
On this stormy day with wild winds,
It’s difficult to stay indoors.
I was at home, with thousands of tasks,
The neighborhood revolves around trivial matters—
My heart pulls me, I must go, go, go!
Today I must leave,
I must leave, my friend.
Whether I want to live or die,
Don’t cry and hold me back—
My companion, I must leave.
O crazy wind today,
What have you brought amongst us?
What does this storm awaken in my mind
With its streams of water,
Why do I get drenched in tears?
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানটি প্রকৃতি পর্যায়ের অন্তর্গত। এই গানে প্রকৃতি ও মানব মনের অনির্বচনীয় যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছে। বাদল দিনের উন্মাদ হাওয়া কবির অন্তরে এক অজানা আকুলতার সৃষ্টি করেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই গানে দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির পরিবর্তন – যেমন ঝড়, বৃষ্টি, বাতাস – মানুষের অন্তরেও পরিবর্তন আনে। প্রাকৃতিক উন্মাদনা মানুষের অন্তরে চাপা থাকা উন্মাদনাকে জাগিয়ে তোলে এবং মানুষকে নতুন পথে যাত্রার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: প্রকৃতি পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯২৪ সাল - ♪
রাগ: বাউল - ♪
তাল: কাহারবা
আলোকের এই ঝর্ণাধারায়
আলোকের এই ঝর্ণাধারায় কে গো আমায় স্নান করালে?
জনমে জনমে কত জুগে জুগে তিমির ঘেরে ছিনু মরিয়া,
কোন্ আলো-করা ভোরে মেঘ সরে গেল গো আমায় দান করালে?
নয়ন মেলিয়া দেখি ধরণী পুলকে পূরিত, আনন্দে নাচে,
জীবন-লীলায় ধন্য হল দেহ মরণ যেন সদূর পাছে॥
কোন্ মন্ত্রবলে কিবা দিলে আনি পুরানো দুখে কষ্ট ভুলালে?
এমন দখিন-হাওয়া ভুবনে কবে বহি গেল, বৃথা হাসি কাঁদি,
মরি মরি আজ মুখরিত মধুপ ফুল-ফোটানো গন্ধে নিরবধি॥
আজি যেন কেহ অচেনা বাণী কানে কানে কথা গান শুনালে?
অনুবাদ:
Who has bathed me in this fountain of light?
Birth after birth, through ages upon ages, I was dying in darkness,
In which light-filled dawn did the clouds part, blessing me with this gift?
Opening my eyes, I see the earth filled with joy, dancing in bliss,
My body is blessed in the play of life, with death seemingly far behind.
By what magical spell have you brought and made me forget old sorrows and pains?
When did such a southern breeze blow through the world, as I laughed and cried in vain,
Oh my, today the bees are buzzing in the flower-blooming fragrance endlessly.
Today, as if someone whispered an unfamiliar melody in my ears?
রচনার প্রেক্ষাপট:
‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায়’ গানটি রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের একটি সংগীত। এই গানে কবি আধ্যাত্মিক জাগরণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
এই গানে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে কিভাবে প্রভুর কৃপায় তিনি দীর্ঘ অন্ধকার থেকে আলোর ঝর্ণাধারায় স্নান করেছেন। দীর্ঘ জন্ম-জন্মান্তরের অজ্ঞানতা ও দুঃখ-কষ্টের পর আত্মিক জাগরণের অভিজ্ঞতা এবং সেই অনুভূতির সৌন্দর্য এই গানে বর্ণিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক আলোকপ্রাপ্তির পর চারপাশের পৃথিবী কিভাবে আনন্দময় ও সুন্দর মনে হয়, তা কবির রচনায় অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে।
- ♪
গীতবিতান অন্তর্গত: পূজা পর্যায় - ♪
রচনাকাল: ১৯৩৯ সাল - ♪
রাগ: ভৈরবী - ♪
তাল: ঝাঁপতাল
উপসংহার: রবীন্দ্র সংগীতের অমর বাণী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই সেরা ১০টি রবীন্দ্র সংগীত আমাদের জীবনে অমূল্য শিক্ষা ও প্রেরণা প্রদান করে। ‘একলা চলো রে’ আমাদের নিজের পথে অবিচলভাবে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেয়, ‘আগুনের পরশমণি’ জীবনের অগ্নি-পরীক্ষায় সম্পূর্ণ শুদ্ধির কথা বলে, ‘আমার সোনার বাংলা’ দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর মাত্রার দিকে ইঙ্গিত করে।