back to top

অপরাজিত উপন্যাস – বিভূতিভূষণের অমর কীর্তি | সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ ও চরিত্র পরিচিতি

- Advertisement -

অপরাজিত উপন্যাস

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর কীর্তি – ‘পথের পাঁচালী’ ট্রিলজির অন্যতম কালজয়ী কিস্তি

অপরাজিতা উপন্যাসের বিষয়বস্তু, অপরাজিতা উপন্যাস বিভূতিভূষণ

অপরাজিত উপন্যাস: এক নজরে

‘অপরাজিত’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি বাংলা উপন্যাস যা তাঁর বিখ্যাত ‘পথের পাঁচালী’ ট্রিলজির দ্বিতীয় খণ্ড। ১৯৩১ সালে প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাসটি হল অপু ও তার পরিবারের কাহিনির অব্যাহত ধারাবাহিকতা — আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য আকাঙ্ক্ষা, জীবনসংগ্রাম এবং মানবমনের গভীর অনুসন্ধান। ‘অপরাজিত’ শব্দটি অর্থবহ, যার অর্থ “যাকে পরাজিত করা যায় না” — যা অপুর অদম্য জীবনী শক্তি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার অবিরাম যাত্রার প্রতীক।

অপরাজিত: মৌলিক তথ্য

  • লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • প্রকাশকাল: ১৯৩১
  • প্রকাশক: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ
  • ভাষা: বাংলা
  • ধরন: উপন্যাস (বিলদুংসরোমান/কামিং অব এজ)
  • ট্রিলজি: পথের পাঁচালী – অপরাজিত – অপুর সংসার

লেখক পরিচিতি

 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। তিনি ভারতের বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাঁকুড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখায় বাংলার গ্রাম্য জীবন, প্রকৃতি এবং মানবমনের সূক্ষ্ম অনুভূতির অনবদ্য চিত্রায়ণ দেখা যায়।

তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’, ‘আরণ্যক’, ‘ইছামতী’, ‘চাঁদের পাহাড়’ অন্যতম। বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫১) এবং মরণোত্তর সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৫৮) লাভ করেন।

‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯), ‘অপরাজিত’ (১৯৩১) এবং ‘অপুর সংসার’ (১৯৩৯) – এই তিনটি উপন্যাস মিলে গঠিত ত্রয়ী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বিভূতিভূষণ তাঁর সাহিত্যে মানবজীবনকে সমগ্রভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন, বিশেষত গ্রামীণ বাংলার মানুষের জীবন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা ও বিরহের কাহিনী অসাধারণ ভাষায় তুলে ধরেছেন।

অপরাজিত উপন্যাসের বিষয়বস্তু

গল্পের সারাংশ

‘অপরাজিত’ উপন্যাসে ‘পথের পাঁচালী’র ধারাবাহিকতায় অপুর জীবন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসটি শুরু হয় অপুর বাল্যকাল থেকে। ভগ্নপ্রায় সংসারে মায়ের (সর্বজয়া) সঙ্গে অপু প্রথমে কাশী, পরে কলকাতায় আসে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে অপু উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। কলকাতার কলেজে পড়াশুনা করার সময় সে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে সে গ্রামে ফিরে যায় এবং সেখানে মায়ের মৃত্যু হয়।

মায়ের মৃত্যুর পর, অপু পুনরায় কলকাতায় ফিরে যায় এবং একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নেয়। সেখানে সে লেখালেখির চর্চা চালিয়ে যায় এবং এক বন্ধুর সঙ্গে মনোষী নামের ছোট্ট একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। এই সময়ে সে আপুর্ব নামে একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করে। এরপর তার জীবনে আসে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন যখন সে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে যায় এবং সেখানে কনে অপ্রিয়া (জ্যোতির্ময়ী) র সাথে তার পরিচয় হয়।

অপ্রিয়ার পিতা যখন বিবাহের শেষ মুহূর্তে পাত্রপক্ষের অতিরিক্ত যৌতুকের দাবির কারণে বিবাহ ভেঙে দিতে চান, তখন অপু সেই বিপদ থেকে কন্যাপক্ষকে রক্ষা করতে নিজেই অপ্রিয়াকে বিবাহ করতে রাজি হয়। প্রথমে অনিচ্ছাকৃত এই বিবাহ, পরে প্রকৃত প্রেমে পরিণত হয়। অপু ও অপ্রিয়া কলকাতায় সুখী দাম্পত্য জীবনযাপন করতে থাকে। কিন্তু তাদের এই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। অপ্রিয়া প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মারা যায়, কিন্তু তাদের পুত্র সন্তান বেঁচে যায়। এই মর্মান্তিক ঘটনায় অপু মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং নবজাতক পুত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা বোধ করে।

শেষে, অপু গ্রামে ফিরে আসে এবং তার পুত্র কাজলকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে চলে যায়। উপন্যাসের শেষে অপু, যদিও জীবনের নানা আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, তবুও অপরাজিত রয়ে যায় – তার জীবনসংগ্রাম অব্যাহত থাকে।

শিক্ষাজীবন ও স্বপ্ন

অপুর শিক্ষাজীবন, কলকাতায় কলেজে পড়া এবং লেখক হওয়ার স্বপ্ন উপন্যাসের একটি মূল উপাদান। এর মাধ্যমে একজন গ্রাম্য যুবকের শহরে এসে শিক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চিত্রিত হয়েছে।

মা-পুত্রের সম্পর্ক

সর্বজয়া ও অপুর মধ্যকার গভীর সম্পর্ক উপন্যাসের অন্যতম শক্তিশালী দিক। মায়ের মৃত্যু অপুর জীবনে এক গভীর শূন্যতা আনে, যা তার পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে।

দাম্পত্য জীবন

অপু ও অপ্রিয়ার দাম্পত্য জীবনের চিত্রণ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা দাম্পত্য প্রেমের উদাহরণ। প্রথমে অনিচ্ছাকৃত বিবাহ, পরে প্রগাঢ় প্রেমে পরিণত হয়।

বিরহ ও শোক

অপ্রিয়ার মৃত্যুর পর অপুর গভীর শোক ও বিরহ উপন্যাসের এক মর্মস্পর্শী অধ্যায়। এই শোকে কাতর অপু জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং পুত্রের প্রতিও বিমুখ হয়ে যায়।

সাহিত্য ও জীবন

অপুর লেখক হওয়ার স্বপ্ন এবং সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে জীবনকে অনুভব করার চেষ্টা উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর মাধ্যমে শিল্পের সাথে জীবনের সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।

পিতা ও পুত্র

অপ্রিয়ার মৃত্যুর পর অপু ও তার পুত্র কাজলের সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করে। অপুর নিজের পিতৃত্ব থেকে পলায়ন এবং পরে সেই সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

অপরাজিত উপন্যাসের প্রধান চরিত্রসমূহ

অপুরবা রায় (অপু)

উপন্যাসের নায়ক। দারিদ্র্যের মধ্যেও অসাধারণ প্রতিভা ও জীবনীশক্তির অধিকারী। সে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং জীবনের নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অটল থাকে। অপু চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অমর সৃষ্টি।

সর্বজয়া

অপুর মা। দারিদ্র্য ও জীবনের নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও অসাধারণ ধৈর্য ও শক্তির সাথে সংসার চালান। ছেলের প্রতি তার অসীম স্নেহ ও মমতা এবং তার উচ্চশিক্ষার জন্য অকাতরে ত্যাগ স্বীকার করেন। তার মৃত্যু অপুর জীবনে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করে।

অপ্রিয়া (জ্যোতির্ময়ী)

অপুর স্ত্রী। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে অপুর সাথে তার বিবাহ হয়, কিন্তু ক্রমে তাদের মধ্যে গভীর প্রেম জন্মায়। সে অপুর সাহিত্যিক প্রতিভাকে সম্মান করত এবং তার লেখালেখির প্রেরণা ছিল। সন্তান প্রসবের সময় তার মৃত্যু অপুর জীবনে গভীর আঘাত হানে।

লীলা

অপুর পড়শি মেয়ে, যার সাথে অপুর প্রথম প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে এই সম্পর্ক খুব বেশি দূর এগোয় না। লীলার চরিত্র কিশোর অপুর রোমান্টিক অনুভূতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পূর্ণ

অপুর বন্ধু। কলকাতায় পূর্ণর সাথে মিলে অপু ‘মনোষী’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। পূর্ণ অপুর লেখালেখির প্রতি উৎসাহী এবং তাকে নানাভাবে সহায়তা করে। সে অপুর জীবনে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে থাকে।

কাজল

অপু ও অপ্রিয়ার পুত্র। তার জন্মের সময়ই অপ্রিয়ার মৃত্যু হয়, যার কারণে অপু কাজলের প্রতি বিতৃষ্ণা বোধ করে। কাজল অপুর শ্বশুরবাড়িতে বড় হয়। উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ড ‘অপুর সংসার’ এ কাজলের চরিত্র আরও বিকশিত হয়।

সাহিত্যিক বিশ্লেষণ

শিরোনামের তাৎপর্য

‘অপরাজিত’ শিরোনামটি উপন্যাসের মূল চিন্তাধারার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। ‘অপরাজিত’ শব্দের অর্থ ‘যাকে পরাজিত করা যায় না’। এই শিরোনামটি নায়ক অপুর অদম্য জীবনীশক্তি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তার অবিরাম লড়াইকে প্রতিনিধিত্ব করে।

জীবনে অপু নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয় – দারিদ্র্য, পারিবারিক বিয়োগান্তক ঘটনা, প্রেমের ক্ষতি – কিন্তু সে কখনোই হার মানে না। বরং প্রতিটি আঘাতের পর সে নতুন করে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই অদম্য জীবনীশক্তি ও আত্ম-পুনরুত্থানের ক্ষমতাই তাকে ‘অপরাজিত’ করে তোলে।

শিরোনামটি শুধু নায়কের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেই নয়, উপন্যাসের সামগ্রিক ভাবধারাকেও প্রতিফলিত করে – মানব জীবনের অজেয় শক্তি, পরাজয়ের মুখে পুনরুত্থানের সংকল্প, এবং নিরন্তর আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষা।

শৈলী ও ভাষা

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনশৈলী অসাধারণ কাব্যময়তা, সহজ-সরল বর্ণনা এবং গভীর অনুভূতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে তিনি একটি আত্মজীবনীমূলক কাহিনি বলার ধরনে চরিত্রের মনোজগতকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করেছেন।

তাঁর ভাষা এমন জীবন্ত যে পাঠক চরিত্রের সুখ-দুঃখের সাথে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম হয়ে পড়েন। অপ্রিয়ার মৃত্যুর পর অপুর শোকাতুর অবস্থার বর্ণনা, কলকাতার শহুরে জীবনের চিত্র, এবং অপু ও তার মায়ের মধ্যকার সম্পর্কের কোমল মুহূর্তগুলি অসাধারণ সংবেদনশীলতা ও বাস্তবতার সাথে উপস্থাপিত হয়েছে।

বিভূতিভূষণের অন্যতম শক্তি হল তাঁর প্রকৃতি বর্ণনা, যা ‘অপরাজিত’-এও প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাম্য পরিবেশের সৌন্দর্য্য, ঋতু পরিবর্তনের ছবি, এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের সাথে চরিত্রের অনুভূতির সম্পর্ক তিনি অনবদ্য কাব্যময়তায় চিত্রিত করেছেন।

উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়

১. আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মসন্ধান

অপুর চরিত্রের মাধ্যমে বিভূতিভূষণ দেখিয়েছেন কীভাবে একজন মানুষ নিজের স্বপ্ন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে এবং সেই প্রক্রিয়ায় নিজেকে আবিষ্কার করে।

২. পরিবর্তনশীল সামাজিক মূল্যবোধ

গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া, শিক্ষার প্রসার, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব – এসব বিষয়ের মাধ্যমে উপন্যাসটি বাংলার সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরেছে।

৩. নিয়তি ও ব্যক্তি স্বাধীনতা

উপন্যাসে দেখা যায় কীভাবে অপুর জীবনে নিয়তির হস্তক্ষেপ ঘটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজের জীবন পথ নির্ধারণে স্বাধীনতা অর্জন করে।

৪. সম্পর্কের জটিলতা

মা-ছেলে, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র – বিভিন্ন সম্পর্কের জটিলতা এবং তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা ও দ্বন্দ্বের সূক্ষ্ম চিত্রণ উপন্যাসের একটি প্রধান দিক।

৫. শোক ও পুনর্জন্ম

প্রিয়জনের মৃত্যু, বিয়োগের বেদনা, এবং সেই শোক থেকে পুনরুত্থানের প্রক্রিয়া উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য বিষয়।

৬. শিল্প ও জীবন

অপুর লেখক হওয়ার স্বপ্ন এবং সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে জীবনকে উপলব্ধি করার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে শিল্প ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য উক্তি

কিন্তু আমি অপরাজিত—আমাকে দমন করিবার সাধ্য কাহারও নাই—আমি চলিবই, জীবনে আমার যাহা পাইবার তাহা সবই পাইব—কোনও শক্তিই আমাকে আটকাইতে পারিবে না।

– অপু

জীবনে দুঃখ আছে, অভাব আছে, কষ্ট আছে, শোক আছে, তাহার জন্য বৃথা আক্ষেপ করিয়া কি লাভ? জীবনের সব কিছুকেই আমি গ্রহণ করিব, কারণ জীবনই তো আমার দেবতা।

– অপরাজিত উপন্যাস

সাহিত্য কী? প্রতিটি লোক, প্রতিটি ঘটনা, জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতার মধ্যে সেই সৌন্দর্য্য, সেই রহস্য অনুভব করার শক্তি যা আমাদের চোখের সামনে প্রতিদিন ঘটছে কিন্তু আমরা দেখতে পাই না।

– অপরাজিত উপন্যাস

সাহিত্যে এবং সংস্কৃতিতে প্রভাব

সাহিত্যিক গুরুত্ব

‘অপরাজিত’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে ‘বিলদুংসরোমান’ বা ‘কামিং অব এজ’ ধরনের উপন্যাসের অন্যতম সেরা উদাহরণ। এটি একটি ব্যক্তির আত্মবিকাশের প্রক্রিয়া, শারীরিক ও মানসিক পরিণতি, এবং জীবনের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বের গঠন প্রক্রিয়াকে সূক্ষ্মভাবে চিত্রিত করেছে।

সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ত্রয়ী’

সত্যজিৎ রায় বিভূতিভূষণের তিনটি উপন্যাস অবলম্বনে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন – ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫), ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) এবং ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)। এই ত্রয়ী বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়।

শিক্ষামূলক মূল্য

‘অপরাজিত’ উপন্যাস বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা রচনা হিসেবে গবেষণা ও সমালোচনামূলক অধ্যয়নের বিষয়।

অপু ত্রয়ীর তুলনামূলক অবস্থান

পথের পাঁচালী (১৯২৯)

ত্রয়ীর প্রথম উপন্যাস। অপুর শৈশব, গ্রাম্য জীবন, পারিবারিক সম্পর্ক, এবং দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারের সংগ্রামের কাহিনী। উপন্যাসের শেষে অপুর বোন দুর্গার মৃত্যু এবং পরিবারের গ্রাম ত্যাগ।

অপরাজিত (১৯৩১)

ত্রয়ীর দ্বিতীয় উপন্যাস। অপুর কৈশোর থেকে যৌবন, শিক্ষা জীবন, লেখক হওয়ার স্বপ্ন, এবং অপ্রিয়ার সাথে বিবাহ ও তার মৃত্যুর পর শোকের অভিজ্ঞতা। মায়ের মৃত্যু এবং একাকী সংগ্রামের কাহিনী।

অপুর সংসার (১৯৩৯)

ত্রয়ীর তৃতীয় ও শেষ উপন্যাস। অপুর পুত্র কাজলের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মাধ্যমে অপুর পুনর্জন্মের কাহিনী।

আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা

‘অপরাজিত’ উপন্যাস প্রকাশের ৯০ বছর পরেও এর প্রাসঙ্গিকতা অম্লান রয়েছে। আজও যুব সমাজের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, জীবনসংগ্রাম, এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই এই উপন্যাসের মর্মবাণী অনুধাবন করে। দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য, শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ – এসব বিষয় আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

সমালোচক ও পাঠকদের মতে, অপুর চরিত্রের মধ্যে যে অদম্য জীবনীশক্তি রয়েছে তা চিরকালীন মূল্যবোধের প্রতীক। জীবনের নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিজের স্বপ্নকে সফল করার এই কাহিনী আজও যুব সমাজের অনুপ্রেরণার উৎস। এছাড়া, উপন্যাসের কাব্যিক ভাষা, চরিত্র চিত্রণ, এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এর সাহিত্যিক মূল্য চিরন্তন করেছে।

অপরাজিত উপন্যাস PDF ডাউনলোড করুন

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ‘অপরাজিত’ উপন্যাসটি আপনার ডিভাইসে রাখুন এবং যে কোন সময় পড়তে পারেন।

PDF ডাউনলোড করুন

উপসংহার

‘অপরাজিত’ উপন্যাস শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়, বিশ্ব সাহিত্যেরও এক অমূল্য সম্পদ। এই উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে এমন আন্তরিকতা, সংবেদনশীলতা ও গভীরতার সাথে চিত্রণ করেছেন যে তা সর্বকালের, সর্বযুগের পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে।

উপন্যাসটির মূল শক্তি হল এর চরিত্রগুলির জীবন্ততা এবং মানবিক আবেদন। অপু, সর্বজয়া, অপ্রিয়া – এই চরিত্রগুলি এতই বাস্তব ও স্বাভাবিক যে পাঠক সহজেই তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, হাসি-কান্নার সাথে একাত্ম হয়ে যান। বিভূতিভূষণের অসাধারণ ভাষা ও কাব্যময় বর্ণনাশৈলী উপন্যাসকে আরও মহিমান্বিত করেছে।

‘অপরাজিত’ উপন্যাসের মূল বার্তা – জীবনের বাধা-বিপত্তি, ব্যর্থতা, দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও অবিরাম সংগ্রাম করে যাওয়া – আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এই কারণেই লেখকের মৃত্যুর সাত দশক পরেও ‘অপরাজিত’ উপন্যাস ও অপু চরিত্র মানুষের কাছে প্রেরণাদায়ক, আদর্শস্বরূপ রয়ে গেছে। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রায়নের মাধ্যমে এই কালজয়ী রচনা বিশ্বব্যাপী পৌঁছেছে এবং বাংলা সাহিত্যের গর্ব ও ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে আছে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যান্য বিখ্যাত রচনা

পথের পাঁচালী

১৯২৯

অপুর সংসার

১৯৩৯

আরণ্যক নামের অর্থ কি, আরণ্যক উপন্যাসের পটভূমি, আরণ্যক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

আরণ্যক

১৯৩৯

চাঁদের পাহাড়

১৯৩৭

ইছামতী

১৯৫০

Latest articles

Related articles