back to top

বেকারের চিঠি কবিতা: পূর্ণাঙ্গ লিরিক্স ও বিশ্লেষণ

বেকারের চিঠি কবিতা: পূর্ণাঙ্গ লিরিক্স ও বিশ্লেষণ

মণিভূষণ ভট্টাচার্যের অমর সৃষ্টি — বাংলা সাহিত্যের একটি অনবদ্য কালজয়ী কবিতা

বইয়ের পাতায় কবিতা
মণিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘বেকারের চিঠি’ বাংলা কবিতার জগতে একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি

ভূমিকা: ‘বেকারের চিঠি’ কবিতা পরিচিতি

‘বেকারের চিঠি’ বাংলা সাহিত্যের একটি অসাধারণ কবিতা, যা ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি বিশিষ্ট বাঙালি কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য রচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা, যা সমাজের বেকার সমস্যা, রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশার একটি আবেগময় চিত্র তুলে ধরে। এই কবিতা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়, যা সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তীক্ষ্ণ সমালোচনা প্রকাশ করে।

কবিতাটি একজন শিক্ষিত বেকার যুবকের আত্মকথন হিসেবে উপস্থাপিত, যিনি নিজের জীবনের কষ্ট, বেকারত্ব এবং সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এর লিরিক্স আমাদের সমাজের সেই অদৃশ্য মানুষদের কথা বলে, যারা শিক্ষিত হয়েও বেকারত্বের যন্ত্রণায় ভোগে, যারা ভোট দেয় কিন্তু ভোটের পর ভুলে যাওয়া হয়, যারা দারিদ্র্য ও হতাশার মধ্যে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়।

কবিতার প্রধান তথ্যাবলী:

    • রচনাকাল: ১৯৮৩
    • কবি: মণিভূষণ ভট্টাচার্য
    • বিষয়বস্তু: বেকারত্ব, সামাজিক অসমতা, রাজনৈতিক ব্যর্থতা
    • ধরন: আধুনিক বাংলা কবিতা
    • গুরুত্ব: সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার তীক্ষ্ণ সমালোচনা

কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য: জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মণিভূষণ ভট্টাচার্য (জন্ম: ১৯৫২) একজন বিশিষ্ট বাংলা কবি এবং লেখক, যিনি তাঁর আবেগময় ও সমাজ-সচেতন কবিতার জন্য পরিচিত। তিনি পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর কবিতাগুলি মূলত সামাজিক অসমতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতার বিষয়গুলিকে তুলে ধরে।

মণিভূষণের কবিতা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাঁর সৃষ্টিশীল রচনা সমাজের বাস্তবতাকে নির্মোহভাবে উপস্থাপন করে, যা সাধারণ মানুষের জীবন ও সংগ্রামকে তুলে ধরে। ‘বেকারের চিঠি’ তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলির মধ্যে একটি, যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে।

তাঁর মূল কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সময়ের শরীরে’, ‘ঘুমের ভিতর আগুন’, ‘নীল জল সবুজ পাতা’, এবং ‘খসড়া শরীরের নকশা’। তাঁর কবিতাগুলি বাংলা সাহিত্যের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং অনেক সাহিত্য সমালোচকের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে।

প্রকৃতির মধ্যে একটি বই
কবিতা সংকলন (প্রতীকী ছবি)

প্রধান সাহিত্যকর্মসমূহ

    • সময়ের শরীরে (১৯৭৭)
    • ঘুমের ভিতর আগুন (১৯৮০)
    • নীল জল সবুজ পাতা (১৯৮৫)
    • খসড়া শরীরের নকশা (১৯৯০)
    • নিরন্তর নিরবতা (১৯৯৫)
    • সময়ের পুকুরপাড় (২০০০)

বেকারের চিঠি: সম্পূর্ণ কবিতা

নিচে ‘বেকারের চিঠি’ কবিতাটির সম্পূর্ণ লিরিক্স দেওয়া হল। এই কবিতাটি ১৯৮৩ সালে মণিভূষণ ভট্টাচার্য রচনা করেছিলেন:

বেকারের চিঠি [১৯৮৩]

মণিভূষণ ভট্টাচার্য

আমার বয়স যে বছর একুশ পূর্ণ হলো 
ভোট দিলাম।
দ্বিতীয়বার যখন চটের পর্দা-ঢাকা খোপরিতে ঢুকে প্রগতিশীল প্রতীক চিহ্নে ছাপ মারছি তখন আমি ছাব্বিশ। ঊনত্রিশ বছর বয়সেও বিশ্বের নিঃস্বতম গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আমার প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু এ বছর ভোটের দিন সারাদুপুর তক্তপোষে শুয়ে বেড়ার ফোকর দিয়ে পতাকা-ওড়ানো রিকসার যাতায়াত দেখেছি কিন্তু ভোট দিতে যাই নি। না, আমি ভোট বয়কট করিনি ভোট আমাকে বয়কট করেছে। কারণ আমার বয়স একত্রিশ। তিরিশের পর সরকারি চাকরি পাওয়া যায় না। যে সরকার আমাকে চাকরি দেবে না — সেই সরকার গঠনের জন্য গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর — এরকম আশা করা যায় না। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অবশ্য বয়স পাঁচ বছর শিথিলযোগ্য, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিশেষ কারণ বিশেষভাবেই অনুপস্থিত। অগত্যা সরকারি চাকরি পাবার একটাই উপায় আছে সার্টিফিকেট জাল করে বয়স কমিয়ে ফেলা। কিন্তু হে নন্দিত নেতৃবৃন্দ, যদিও আমার চোখের উপর আপনাদের অনির্বচনীয় লীলাময় জীবন খোলা আছে তবু জালিয়াৎ হতে পারবো না — আমার বাবা সৎ ছিলেন। এই গঞ্জের বাজারে, ন্যাড়া ছাতিমতলায়, কাঁচাপাকা চুলে, পুরু কাচের চশমা চোখে যে বৃদ্ধটি কুঁজো হয়ে মান্ধাতার আমলের টাইপরাইটারে আমার এবং আমার মতো শত শত চাকরিপ্রার্থী এবং ভোটদাতা অর্থাৎ আপনাদের পরমান্নদাতা যুবকের হাজার হাজার দরখাস্ত টাইপ ক’রে দিতেন — একদিন ভরদুপুরে তার বুকের বাঁদিকের লজঝড়ে টাইপমেশিনটা বিগড়ে গেল। সেই ফাঁকা জায়গায় আমি কলা নিয়ে বসে পড়লাম। কার্বাইডে পাকানো চালানী মর্তমান কলার রঙ যদিও বোম্বাই-অভিনেত্রীর চটককেও হার মানায়, তবু খেতে অতিশয় অখাদ্য, ফলে আমাকে ডাবের সঙ্গে ভাব জমাতে হোলো। পা ফাক করে দাঁড়িয়ে ধুতি-পাঞ্জাবী শার্ট-প্যান্ট যখন সরু নল দিয়ে চোঁ চোঁ করে সুমিষ্ট জল টেনে নিতো, তাদের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে আমি এই গঞ্জের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানুষের মর্মান্তিক মহিমাকে স্পর্শ করতাম। ডাবের খোলাটি ছুঁড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে, ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে দেখতাম, অধিকাংশ অমেরুদণ্ডী বুদ্ধিজীবীদের মতোই, ভিতরে শাঁস আছে কিনা। তারপর চিরুনী ব্লাউজ ধূপকাঠি তরমুজ চাল হোসিয়ারী মাল এবং ধূর্ত নেতা পূর্তমন্ত্রী হবার জন্য যত বড় স্বপ্ন দেখে ঠিক সেই আয়তনের মিষ্টি কুমড়ো অর্থাৎ একের পর এক বহুমুখী বাণিজ্য বিস্তারে আমি বিড়লাকেও ছাড়িয়ে গেলাম, কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়লো না। ফলে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মা মারা গেলেন। আমাদের এখানে গত কুড়ি বছরে আধখানা হাসপাতাল হয়েছে, বাকি আধখানা হবে না, কারণ প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা অধিকাংশই ডাক্তার এবং তাদের নার্সিং হোম আছে। রোজ ভোর চারটেয় উঠে আমি যখন বস্তির গণতান্ত্রিক খাটা পায়খানায় লাইন দিতাম, মা নিজের – হাতে – দেওয়া ঘুঁটে জ্বালিয়ে চা করে দিতেন। সেই স্যাঁতসেতে অন্ধকারে ধোঁয়াটে আগুনের সামনে বসে-থাকা মা- কে আমার ভারতবর্ষ বলে মনে হোতো। দিদির মৃতদেহ দড়ি কেটে নামাবার পর থেকে মা একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। যার সঙ্গে দিদির বিয়ে হয়েছিলো সে গরীব ছিলো এবং ভালো ছিলো। কিন্তু দারিদ্র্য তাকে মহানও করেনি বা খ্রীষ্ট্রের সম্মানও দেয় নি — এক চোরাকারবারি শ্রমিকনেতার আড়কাঠিতে পরিণত করেছিলো। সে সেই নেতাকে মহিলা সরবরাহ করতো — সেই নেতার সঙ্গে মন্ত্রীর যোগাযোগ ছিলো, মন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রের যোগ ছিলো, কেন্দ্রের সঙ্গে পরিধির যোগ ছিলো, পরিধির সঙ্গে ব্যাস এবং ব্যাসের সঙ্গে ব্যাসার্ধের সংযোগ ছিলো এবং এইসব সূক্ষ্ম যোগাযোগগুলি একসঙ্গে গিঁট লেগে একটা মোটা নাইলনের দড়ি হয়ে দিদির গলায় ফাঁস লাগিয়েছিলো। চাকরি আমার হতো। জেলার সব ছাত্রদের মধ্যে আমি যদি মাতৃভাষায় প্রথম না হয়ে আপনাদের পিতৃভাষা অর্থাৎ ইংরেজিতে প্রথম হতাম, হয়তো আমার বরাত খুলে যেতো। অথবা আমার বন্ধুরা — যারা ঠিক ঠিক জায়গায় তেল সরবরাহে আরব রাষ্ট্রগুলিকেও হার মানিয়েছে — আমি যদি তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারতাম তাহলে আমার গলায় বাদামের ঝুড়ির বদলে নেকটাই ঝুলতো। গর্তে-ঢুকে-যাওয়া ফ্যাকাসে হলুদ রঙের দুটো চোখের শূন্য দৃষ্টি এবং একটা অকেজো টাইপ মেশিন ছাড়া বাবা আমার জন্য আর কিছু রেখে যেতে পারেন নি। এ বছর জীবনের সর্বশেষ ভোটটি দিয়ে মা চলে গেলেন। ভারতবর্ষ পড়ে রইলো। আমার আর কোনো দায় নেই। যেহেতু আজকের দর্শন আগামীকালের সংস্কার মাত্র এখন যদি আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাই। বন্ধুরা বলবে, ‘পালিয়ে গেল’। বিদেশি টাকায় পুষ্ট যে সব তথাকথিত জনসেবা প্রতিষ্ঠান আছে — তাতে যদি ভাতের জন্য ঢুকে পড়ি — তারা বলবে, ‘ব্যাটা গুপ্তচর’। যদি আত্মহত্যা করি — তাহলে, ‘কাপুরুষ’। আর যদি সোজাসুজি প্রতিবাদ করি — তাহলে আপনারা, রাজনৈতিক নৈশ প্রহরীরা কালো টাকার কুমিরদের অন্ধকার পাড়ায় গিয়ে মাঝরাতে ‘নকশাল’ ‘নকশাল’ ব’লে ঘেউ ঘেউ করে তাদের জাগিয়ে দেবেন এমন কি অবস্থা তেমন তেমন বেগতিক দেখলে আপনাদের সঙ্গে রাশিয়া আমেরিকাও যোগ দেবে। এতদিন চাকরি খুঁজেছি। পাই নি। এবার ভাবছি আমরাই আপনাদের চাকরি দেবো। আমরা যারা বেকার আধাবেকার ভবঘুরে বাউন্ডুলে ভিখিরি — যাদের জমি নেই কিন্তু জমিতে খাটে — বাড়ি বানায় কিন্তু বাড়ি নেই — যারা শহরে আলো জ্বালে কিন্তু যাদের কুপিতে তেল নেই — যারা কারখানা বানায়, কিন্তু কারখানা যাদের আস্তাকুঁড়ে চালান করে দেয় যারা কোনোদিন একটা ভালো জামা পরেনি, সরবত খায় নি, বেড়াতে গিয়ে পর্বতমালার স্তব্ধ নিরাসক্তি ও মহত্ত্বকে স্পর্শ করেনি, যারা জন্মায় আর খাটে, খাটে আর মরে, যারা পিপড়ের মতো পোকামাকড়ের মতো শীত-রাত্রির ঝরাপাতার মতো — সেইসব নিরক্ষর নগণ্য কুঁজো অবজ্ঞাত করুণ যাদের দেখার জন্য এবং ঠকাবার জন্য আপনারা বিরাট মঞ্চে উঠে দাঁড়ান — যারা আগামীদিনের ভারতবর্ষের, গোটা পৃথিবীর এবং সৌরজগতের মালিক — আমি তাদেরই একজন হয়ে এই জংশনে স্টেশনে বাদাম বেচে যাচ্ছি। কশাইয়ের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের মতো জীবন আমাদের — যে-কোনো মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারি — আবার এই আঙুলের কেন্দ্রীভূত চাপে খোলা ফাটিয়ে বের করে আনা যায় রাজনৈতিক ক্ষমতার পুষ্টিকর তৈলবীজ, আর সমস্ত শুকনো খোসা বাতাসে উড়ে যায়, বাতাসের সঙ্গে আকাশ স্পর্শ করে মানুষের অনন্ত ঘৃণার আগুন — সেই আগুনের পাশে বসে আছেন আমার মা, আমার দেশজননী। না, ‘বিপ্লব’ শব্দটি শুনলেই আপনাদের মতো আমার কম্প দিয়ে জ্বর আসে না।
 

কবিতার বিষয়বস্তু ও বিশ্লেষণ

‘বেকারের চিঠি’ কবিতাটি একজন শিক্ষিত বেকার যুবকের আত্মকথন, যা সমাজের অসংখ্য সমস্যা, রাজনৈতিক ব্যর্থতা, এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে তুলে ধরে। এই কবিতার প্রধান বিষয়গুলি এবং তাদের বিশ্লেষণ নিম্নরূপ:

১. বেকারত্ব ও তার প্রভাব

কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় হলো বেকারত্ব এবং তার ফলে সৃষ্ট হতাশা ও ক্ষোভ। কবি দেখিয়েছেন কিভাবে একজন শিক্ষিত যুবক চাকরি না পেয়ে ছোট ব্যবসা শুরু করতে বাধ্য হয়, কিন্তু সেখানেও সফল হতে পারে না। তিরিশ বছর বয়সের পর সরকারি চাকরি পাওয়ার সুযোগ না থাকা এবং সরকারি নীতিমালার যান্ত্রিকতা তাকে আরও হতাশাগ্রস্ত করে তোলে।

২. রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ

কবিতাটিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। কবি দেখান কিভাবে সাধারণ মানুষ ভোট দেয়, কিন্তু ভোটের পর তাদের চাহিদাগুলি উপেক্ষিত হয়। ভোটাধিকার প্রয়োগ করে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, তা সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত করতে ব্যর্থ হয়।

“না, আমি ভোট বয়কট করিনি ভোট আমাকে বয়কট করেছে। কারণ আমার বয়স একত্রিশ। তিরিশের পর সরকারি চাকরি পাওয়া যায় না।”

৩. দারিদ্র্য ও সামাজিক অসমতা

কবিতাটি দারিদ্র্য ও সামাজিক অসমতার চিত্র তুলে ধরে। কবি মায়ের অসুস্থতা এবং চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশাকে তুলে ধরেছেন। দিদির আত্মহত্যার ঘটনার মাধ্যমে সমাজের ভ্রষ্টাচার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসৎ সংযোগগুলি ফুটে উঠেছে।

৪. প্রতিবাদী চেতনা

কবিতার শেষ দিকে প্রতিবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। কবি বলেছেন, “এতদিন চাকরি খুঁজেছি। পাই নি। এবার ভাবছি আমরাই আপনাদের চাকরি দেবো।” এটি সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে দাঁড়াবে। “বিপ্লব” শব্দের উল্লেখও একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

৫. শিল্পগত বৈশিষ্ট্য

কবিতাটি আত্মজীবনীমূলক শৈলীতে লেখা, যেখানে কবি প্রথম পুরুষে নিজের কথা বলেছেন। এর ভাষা সরল, সহজবোধ্য এবং মর্মস্পর্শী। কবিতায় চিত্রকল্প ও রূপকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। “পিপড়ের মতো”, “শীত-রাত্রির ঝরাপাতার মতো” ইত্যাদি উপমাগুলি সাধারণ মানুষের অবস্থা ও সামাজিক অবস্থানকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে।

কবিতার উল্লেখযোগ্য রূপক ও উপমাসমূহ

    • ধোঁয়াটে আগুনের সামনে বসে-থাকা মা: ভারতবর্ষের প্রতীক
    • নাইলনের দড়ি: রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার জটিল সম্পর্ক
    • কশাইয়ের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল: সাধারণ মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তা
    • পিপড়ে, পোকামাকড়, ঝরাপাতা: সমাজে অবহেলিত মানুষদের অবস্থান

সমাজ ও সাহিত্যে ‘বেকারের চিঠি’র প্রভাব

‘বেকারের চিঠি’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বাংলা সাহিত্য ও সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই কবিতাটি সাহিত্যিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে:

সমাজের প্রতীকী চিত্র
সমাজ-সচেতন সাহিত্য একটি প্রভাবশালী হাতিয়ার (প্রতীকী ছবি)

সাহিত্যিক মূল্যায়ন

    • আধুনিক কবিতার ধারায় অবদান: এটি আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন ধারার সূচনা করেছিল। সরাসরি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের উপস্থাপনা এবং প্রতিবাদী ভাষার ব্যবহার বাংলা কবিতায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল।
    • সাহিত্যিক স্বীকৃতি: কবিতাটি বিভিন্ন সাহিত্যিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। অনেক সাহিত্যিক সমালোচক এটিকে বাঙালি জীবনের একটি সত্য ও বাস্তব চিত্র হিসেবে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।
    • পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্তি: কবিতাটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাংলা সাহিত্যের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা এর সাহিত্যিক গুরুত্ব প্রমাণ করে।

সামাজিক প্রভাব

    • বেকারত্ব নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি: কবিতাটি বেকারত্বের সমস্যা ও তার প্রভাব নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে বেকারত্বের সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল।
    • রাজনৈতিক সচেতনতা: কবিতাটি তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও তার ব্যর্থতাগুলি নিয়ে গভীর ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। এটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
    • প্রতিবাদী সংস্কৃতির উন্মেষ: কবিতাটি বিভিন্ন প্রতিবাদী আন্দোলন ও সংস্কৃতিতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। অনেক ছাত্র-যুব আন্দোলনে এই কবিতাটি প্রেরণার উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
“‘বেকারের চিঠি’ শুধু একটি কবিতা নয়, এটি একটি সামাজিক দলিল, যা বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা এবং ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই কবিতার প্রতিটি লাইন বাঙালি জীবনের বাস্তবতাকে স্পর্শ করে।”

– বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক

ইংরেজি ও হিন্দিতে অনুবাদ

‘বেকারের চিঠি’ কবিতাটি তার গভীর সামাজিক বার্তা এবং সাহিত্যিক গুণমানের কারণে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এখানে কবিতাটির ইংরেজি ও হিন্দি অনুবাদের কিছু অংশ দেওয়া হল:

ইংরেজি অনুবাদ (অংশবিশেষ)

“The Unemployed’s Letter [1983] by Manibhushan Bhattacharya

The year I turned twenty-one— I voted. The second time when I entered the jute-curtained booth Stamping the progressive symbol, I was twenty-six. Even at twenty-nine, my heart yearned To protect the world’s poorest democracy. But this year, on election day, I lay on my cot all afternoon Watching the flag-bearing rickshaws through the holes in the fence But I did not go to vote.

No, I did not boycott the vote The vote boycotted me. Because I am thirty-one years old. After thirty, one cannot get a government job. The government that will not give me a job— For the formation of such a government I cannot be expected to feel thrilled or dazed.

In special cases, of course, the age limit can be relaxed by five years, But in my case, special reasons are Specially absent. Hence, there is only one way to get a government job To forge certificates and reduce my age. But O revered leaders, although before my eyes Your ineffable playful lives lie open I cannot become a forger— My father was honest.”

হিন্দি অনুবাদ (অংশবিশেষ)

“बेरोजगार का पत्र [१९८३] मणिभूषण भट्टाचार्य

जिस साल मेरी उम्र इक्कीस पूरी हुई — मैंने वोट दिया। दूसरी बार जब मैं टाट के परदे वाले बूथ में घुस कर प्रगतिशील प्रतीक चिन्ह पर छाप मार रहा था तब मैं छब्बीस का था। उनतीस साल की उम्र में भी दुनिया के सबसे गरीब लोकतंत्र की रक्षा के लिए मेरा प्राण व्याकुल हो उठा था। लेकिन इस साल चुनाव के दिन मैं सारी दोपहर चारपाई पर लेटा बाड़ के छेद से झंडा-उड़ाते रिक्शों का आना-जाना देखता रहा लेकिन वोट देने नहीं गया।

नहीं, मैंने वोट का बहिष्कार नहीं किया वोट ने मेरा बहिष्कार किया है। क्योंकि मेरी उम्र इकतीस है। तीस के बाद सरकारी नौकरी नहीं मिलती। जो सरकार मुझे नौकरी नहीं देगी — उस सरकार के गठन के लिए मुझमें पुलक जगे आँखों में आवेश भरे — ऐसी उम्मीद नहीं की जा सकती।

विशेष मामलों में अवश्य उम्र पाँच साल तक शिथिल की जा सकती है, लेकिन मेरे मामले में विशेष कारण विशेष रूप से अनुपस्थित हैं। अतः सरकारी नौकरी पाने का एक ही उपाय है सर्टिफिकेट जाली करके उम्र कम कर लेना। लेकिन हे आदरणीय नेतागण, यद्यपि मेरी आँखों के सामने आपका अनिर्वचनीय लीलामय जीवन खुला है फिर भी जालसाज नहीं बन सकूँगा — मेरे पिता ईमानदार थे।”

এই অনুবাদগুলি মূল বাংলা কবিতার আবেগ ও ভাবকে ধরে রাখার চেষ্টা করলেও, কবিতার ভাষাগত সূক্ষ্মতা, সাংস্কৃতিক নিদর্শন এবং আঞ্চলিক প্রসঙ্গগুলিকে সম্পূর্ণভাবে অন্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তবে এই অনুবাদগুলি বাংলা ভাষা-ভাষী নয় এমন পাঠকদের কাছে কবিতাটির মূল বক্তব্য পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।

উপসংহার

‘বেকারের চিঠি’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ, যা শুধু একটি কবিতা নয়, বরং একটি সামাজিক দলিল হিসেবেও কাজ করে। এটি বেকারত্ব, দারিদ্র্য, সামাজিক অসমতা, এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার একটি সাহসী চিত্র তুলে ধরেছে। কবিতাটির আবেগময় ভাষা, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা, এবং রাজনৈতিক সচেতনতা এটিকে বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে।

মণিভূষণ ভট্টাচার্যের এই কবিতা তার প্রকাশের প্রায় চার দশক পরেও প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে, কারণ বেকারত্ব, দারিদ্র্য, এবং সামাজিক অসমতার সমস্যাগুলি আজও আমাদের সমাজের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। কবিতাটির প্রতিবাদী চেতনা এবং সামাজিক বাস্তবতার প্রতি সচেতনতা আমাদের আজও ভাবিত করে এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়।

‘বেকারের চিঠি’ শুধু একটি কবিতা নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন, একটি প্রতিবাদের ভাষা, এবং একটি অসাধারণ সাহিত্যিক সৃষ্টি। এই কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে চিরকাল মনে রাখার মতো একটি রচনা হিসেবে থেকে যাবে।

© ২০২৫ | সর্বসত্ব সংরক্ষিত। এই নিবন্ধটি শুধুমাত্র শিক্ষামূলক ও গবেষণামূলক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের গানের তালিকা: যে সুরে কেঁদেছে বাংলাদেশ

 /* Global Styles */ body { font-family: 'Noto Serif Bengali', serif; background-color: #fdfdfd; color: #333; margin: 0;...

ভালো হিন্দি গান | ৫০০+ সেরা বলিউড গানের সম্পূর্ণ তালিকা ২০২৫

ভালো হিন্দি গান আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আবেগ এবং অনুভূতির সাথে জড়িত। বলিউডের সুরেলা জগতে রয়েছে হাজারো মধুর গান যা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।...

৫০টি সুপারহিট হিন্দি গান | All Time Superhit

"হিন্দি গান" আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আরও সুন্দর করে তোলে। বলিউডে বিভিন্ন ঘরানার গান তৈরি হয়েছে, যা আমাদের প্রেম, দুঃখ, আনন্দ, এবং স্মৃতিকে আরও...

2000+ বিশ্বের সব টিভি চ্যানেল | সব দেশের এবং সবধরনের ক্যাটাগরি

আধুনিক যুগে বিশ্বের সব টিভি চ্যানেল সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি দেশে রয়েছে নিজস্ব টেলিভিশন নেটওয়ার্ক যা স্থানীয় সংস্কৃতি, ভাষা এবং বিনোদনের চাহিদা পূরণ...

আলিশা চিনয় – বলিউডের বেবি ডল | ২৭ টি বিখ্যাত গান

আলিশা চিনয় - বলিউডের কুইন অফ ইন্ডি পপ | সেরা গানের সংগ্রহ🎵 এই আর্টিকেলে যা পাবেন:🎶 আলিশা চিনয় কেন এত জনপ্রিয়? 👑 আলিশা...