সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার নামের তালিকা
বাংলা সিনেমার জনক এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত সিনেমার বিস্তারিত বিবরণ
সত্যজিৎ রায়: এক বিস্ময়কর প্রতিভা
সত্যজিৎ রায় (২ মে, ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২) ছিলেন একজন বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা, গল্পকার, প্রকাশক, চিত্রশিল্পী, গ্রাফিক ডিজাইনার, সংগীত রচয়িতা এবং সমালোচক যিনি বিশ্বব্যাপী তাঁর অসামান্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সমাদৃত। তিনি তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, যা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল।
সত্যজিৎ রায়ের কিছু বিশেষ তথ্য
- জন্ম: ২ মে, ১৯২১, কলকাতা, ভারত
- মৃত্যু: ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২ (৭০ বছর বয়সে)
- পেশা: চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক, চিত্রশিল্পী, সংগীতজ্ঞ
- সর্বমোট চলচ্চিত্র: ৩৬টি (ফিচার ফিল্ম, ডকুমেন্টারি এবং শর্ট ফিল্ম সহ)
- বিশেষ পুরস্কার: অস্কার (আজীবন সম্মাননা), ভারতরত্ন, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার
সত্যজিৎ রায় তাঁর ৪০ বছরের কর্মজীবনে অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তাঁর সিনেমাগুলি বাংলা সাহিত্য, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী, সমাজের সংঘাত, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং গ্রাম্য জীবনের সহজ-সরল চিত্র তুলে ধরে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সম্পূর্ণ তালিকা
সত্যজিৎ রায় তাঁর কর্মজীবনে মোট ৩৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে ২৯টি ফিচার ফিল্ম এবং ৭টি ডকুমেন্টারি ও শর্ট ফিল্ম। এখানে তাঁর সব চলচ্চিত্রের একটি সম্পূর্ণ তালিকা দেওয়া হল:
অপু ত্রয়ী
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত, এই ছবিতে দেখানো হয়েছে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের গল্প যাদের ছেলে অপু এবং মেয়ে দুর্গা। ক্যান ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কার জিতেছিল।
অপু ত্রয়ীর দ্বিতীয় ছবি, যেখানে অপু কিশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠে। তার বাবা-মা এবং বোন দুর্গার মৃত্যুর পর সে কলকাতায় পড়াশোনার জন্য চলে আসে।
অপু ত্রয়ীর শেষ ছবি, যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক অপুর বিবাহিত জীবন এবং পরবর্তীতে তার স্ত্রী অপর্ণার মৃত্যুর পর, তার ছেলে কাজলের সাথে সম্পর্কের গল্প বর্ণনা করা হয়েছে।
১৯৫০-এর দশক
পরশুরামের (রাজশেখর বসু) দুটি গল্প “পরশপাথর” এবং “জলসাঘর” অবলম্বনে নির্মিত একটি কৌতুক-ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্র।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের গল্প অবলম্বনে নির্মিত, এই ছবিতে একজন জমিদারের গল্প বলা হয়েছে যিনি সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা বজায় রাখতে চান, কিন্তু তাঁর সম্পত্তি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
প্রবোধকুমার সান্যালের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত, এই ছবিতে একটি পরিবারে অন্ধবিশ্বাসের প্রভাব এবং এর ভয়াবহ পরিণতির গল্প বলা হয়েছে।
১৯৬০-এর দশক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি গল্প – “পোস্টমাস্টার”, “মনিহারা” এবং “সমাপ্তি” অবলম্বনে নির্মিত তিনটি ছোট গল্পের সংকলন।
দার্জিলিংয়ে ছুটি কাটাতে আসা বিভিন্ন চরিত্রের গল্প যারা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের দর্শনে নিজেদের জীবন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি লাভ করে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “অরণ্যের অধিকার” উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত, এই ছবিতে একটি বিনোদন ভ্রমণ যাত্রায় চার বন্ধুর অভিজ্ঞতার গল্প বলা হয়েছে।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটগল্প “অবতরণিকা” অবলম্বনে নির্মিত, এই ছবিতে কলকাতার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলা হয়েছে, যেখানে একজন গৃহবধূ তার পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য চাকরি করতে শুরু করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নষ্টনীড়” গল্প অবলম্বনে নির্মিত, এই ছবিতে ১৯ শতকের শেষভাগে বাংলার উচ্চবিত্ত সমাজের পটভূমিতে একটি বিবাহিত দম্পতির সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে গল্প বলা হয়েছে।
একটি চিড়িয়াখানায় এক দিনের ঘটনা নিয়ে এই ছবিতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের আচরণ এবং মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত, এই ফ্যান্টাসি-কমেডি চলচ্চিত্রে দুই অপ্রতিভ সংগীতজ্ঞের অলৌকিক শক্তি অর্জন এবং তাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বলা হয়েছে।
১৯৭০-এর দশক
সত্যজিৎ রায়ের নিজের লেখা ফেলুদা সিরিজের উপর ভিত্তি করে নির্মিত, এটি একটি গোয়েন্দা থ্রিলার যেখানে প্রদোষ মিত্র (ফেলুদা) একটি গুপ্তধনের রহস্য সমাধান করেন।
সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের আরেকটি চলচ্চিত্র, যেখানে ফেলুদা বারাণসীতে একটি মূল্যবান মূর্তি চুরির রহস্য উদঘাটন করেন।
১৯৮০-১৯৯০ এর দশক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত, ব্রিটিশ শাসনের সময় স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে এক দম্পতির জীবনে রাজনীতি ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের দ্বন্দ্ব নিয়ে এই ছবি।
সত্যজিৎ রায়ের শেষ চলচ্চিত্র, এই ছবিতে একজন আগন্তুকের আগমন এবং তার মাধ্যমে মানবতাবাদী মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠার গল্প বলা হয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের ডকুমেন্টারি এবং শর্ট ফিল্ম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র।
বিখ্যাত ভারতীয় নর্তকী বালাসরস্বতীর নৃত্যকলা নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি।
সত্যজিৎ রায়ের পুরস্কার ও সম্মাননা
সত্যজিৎ রায় তাঁর চলচ্চিত্র কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন। এখানে তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের তালিকা দেওয়া হল:
অস্কার (আজীবন সম্মাননা)
১৯৯২ সালে আমেরিকান একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস সত্যজিৎ রায়কে “মানবতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, করুণা এবং সহানুভূতির জন্য এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য” অস্কার পুরস্কারে ভূষিত করে। এটি ছিল তাঁর মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা।
ভারতরত্ন
১৯৯২ সালে, ভারত সরকার সত্যজিৎ রায়কে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করে।
সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি ও উত্তরাধিকার
সত্যজিৎ রায়ের অবদান শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি একজন চিত্রশিল্পী, গ্রাফিক ডিজাইনার, সংগীতজ্ঞ এবং লেখক হিসেবেও সমান দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীল কাজকর্ম ভারতীয় সংস্কৃতি এবং বিশ্ব শিল্পকলায় অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলেছে।
সত্যজিৎ রায়ের লেখালেখি
সত্যজিৎ রায় একজন প্রতিভাবান লেখক ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য ছোটগল্প, উপন্যাস এবং কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে:
- ফেলুদা সিরিজ (গোয়েন্দা উপন্যাস)
- প্রফেসর শঙ্কু সিরিজ (বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী)
- গল্প ১০১ (ছোটগল্পের সংকলন)
- আমার কথা (আত্মজীবনী)
সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবি
সত্যজিৎ রায় একজন অসাধারণ চিত্রশিল্পী ছিলেন। তিনি তাঁর নির্মিত অনেক চলচ্চিত্রের পোস্টার, কভার ডিজাইন এবং স্টরিবোর্ড নিজেই আঁকতেন। এছাড়াও তিনি বই এবং ম্যাগাজিনের জন্য অসংখ্য ইলাস্ট্রেশন তৈরি করেছেন।
তাঁর টাইপোগ্রাফি ডিজাইনও খুব প্রশংসিত। তিনি ‘রে রোমান’ নামক একটি ফন্ট ডিজাইন করেছিলেন যা আজও বাংলা প্রকাশনায় ব্যবহৃত হয়।
আমি বিশ্বাস করি যে চলচ্চিত্র হল ইচ্ছা আর উদ্দেশ্যের সমন্বয়, আর একজন পরিচালকের কাজ হল সেই ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করা।
সত্যজিৎ রায়ের অস্কার প্রাপ্ত সিনেমা
সত্যজিৎ রায় কোন নির্দিষ্ট সিনেমার জন্য অস্কার পাননি, তিনি তাঁর সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে আজীবন সম্মাননা (Lifetime Achievement) হিসেবে “Academy Honorary Award” পেয়েছিলেন। তবে তাঁর অনেক সিনেমা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেমন:
- পথের পাঁচালী – ক্যান ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কার (১৯৫৬)
- অপরাজিত – ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘Golden Lion’ পুরস্কার (১৯৫৭)
- অপুর সংসার – বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘Golden Bear’ পুরস্কার অর্জন (১৯৬০)
- চারুলতা – বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘Silver Bear for Best Director’ পুরস্কার (১৯৬৫)
উপসংহার
সত্যজিৎ রায় শুধু বাংলা সিনেমায় নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য এবং অমর ব্যক্তিত্ব। তাঁর সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিক মূল্যবোধ এবং সূক্ষ্ম শিল্পসুলভ উপস্থাপনা তাঁকে সর্বকালের সেরা পরিচালকদের অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের তালিকা একটি অমূল্য সম্পদ যা ভারতীয় এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৃষ্টিশীলতা এবং আর্টিস্টিক দক্ষতার জন্য অনুপ্রাণিত করতে থাকবে।
সত্যজিৎ রায়ের উক্তি
- “সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করাই আমার লক্ষ্য, তাদের জন্য যারা চিন্তা করে, অনুভব করে, যাদের অভিজ্ঞতা এবং আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।”
- “চলচ্চিত্র নির্মাণ আমার কাছে একটি যাত্রা – আমি কোনো বার্তা প্রেরণ করার চেষ্টা করি না, আমি একটি অভিজ্ঞতা প্রদান করি।”
- “আমি প্রশিক্ষিত মতে সংগীতজ্ঞ নই, চিত্রশিল্পী নই, লেখক নই – কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমি এই সব কিছু একসাথে করতে পারি।”
- “আমার সিনেমাগুলি বিশ্বজনীন – এগুলি সব জাতির, ধর্মের, বা বয়সের মানুষের জন্য।”