সাতকাহন উপন্যাস রিভিউ: সমরেশ মজুমদারের অসাধারণ কীর্তি
লেখক: সাহিত্য বিশ্লেষক
প্রকাশিত:

ভূমিকা: সাতকাহন উপন্যাস পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় ও বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যে ‘সাতকাহন’ উপন্যাসটি একটি অনন্য স্থান দখল করে আছে। বাংলা সাহিত্যে একটি অবিস্মরণীয় উপন্যাস হিসাবে পরিচিত এই রচনায় লেখক তার অনন্য শৈলীতে মানবিক অনুভূতি, সামাজিক সংঘাত এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই পাঠকমহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং কালজয়ী সাহিত্যকর্ম হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
‘সাতকাহন’ শব্দটির তাৎপর্য রয়েছে প্রাচীন বাংলা লোককথা থেকে, যেখানে ‘সাত’ অর্থাৎ সাতটি ভিন্ন গল্প বা কাহিনি একত্রিত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্ত তৈরি করে। উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার সাতটি আলাদা কিন্তু পরস্পর সম্পর্কিত কাহিনির মাধ্যমে বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবিক সম্পর্ক, এবং ব্যক্তির অস্তিত্বগত সংকটের চিত্র অঙ্কন করেছেন।
এই আর্টিকেলে আমরা সাতকাহন উপন্যাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব – এর বিষয়বস্তু, উল্লেখযোগ্য চরিত্র, বিখ্যাত উক্তি, সারাংশ, মূল্য এবং সাহিত্যিক গুরুত্ব। সমরেশ মজুমদারের এই অসাধারণ সৃষ্টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা নিয়ে আমরা শুরু করি এই বিশ্লেষণ।
সাতকাহন উপন্যাসের বিষয়বস্তু
‘সাতকাহন’ উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার সাতটি পরস্পর সম্পর্কিত গল্পের মাধ্যমে বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাস ও সমাজের একটি বিস্তৃত চিত্র উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের কালপরিসর ১৯৪০-এর দশক থেকে শুরু করে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে দেশভাগ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, নকশাল আন্দোলন, এবং মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের নানা উত্থান-পতনের চিত্র দেখা যায়।
প্রধান বিষয়বস্তু:
- দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা: উপন্যাসের প্রথম অংশে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা উদ্বাস্তুদের জীবনসংগ্রাম, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট চিত্রিত হয়েছে।
- নকশাল আন্দোলন: ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে শুরু হওয়া নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং এর প্রভাবে বাংলার তরুণ সমাজের রাজনৈতিক উত্থান ও পতনের চিত্র।
- পারিবারিক সম্পর্ক: পরিবর্তনশীল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতা, প্রজন্ম সংঘাত, এবং মূল্যবোধের পরিবর্তন।
- শহরায়ন ও মধ্যবিত্ত জীবন: গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের জীবন সংগ্রাম, কলকাতার শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র, এবং শহরায়নের ফলে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন।
- রাজনীতি ও ব্যক্তি জীবন: রাজনীতি কীভাবে ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত করে এবং মানুষের আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটায়, সেই জটিল সম্পর্কের চিত্রায়ণ।
উপন্যাসের বিশেষত্ব হল এর অসাধারণ কাঠামো, যেখানে সাতটি আপাত বিচ্ছিন্ন কাহিনি একে অপরের সাথে সূক্ষ্ম সূত্রে বাঁধা পড়ে একটি সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত তৈরি করেছে। প্রতিটি কাহিনি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও অন্য কাহিনিগুলির সাথে সম্পর্কিত, যা পাঠকদের একটি জটিল তবে সম্পূর্ণ চিত্র দেখার সুযোগ করে দেয়।
সমরেশ মজুমদার তাঁর অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গি দিয়ে কলকাতার গলিঘুঁজি, উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ পরিবেশ, পলিটিক্যাল মিটিং, ছাত্র সংগঠন, এবং পারিবারিক জীবনের সূক্ষ্ম চিত্র এঁকেছেন। তাঁর ভাষার জাদু পাঠককে সেই সময়ের বাস্তবতায় নিয়ে যায়, যেখানে রাজনীতি, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সংগীত সবকিছুই একটি পরিবর্তনশীল সমাজের প্রতিচ্ছবি।
সাতকাহন উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণ
‘সাতকাহন’ উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার একগুচ্ছ স্মরণীয় এবং বহুমাত্রিক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। এই চরিত্রগুলির মাধ্যমে সেই সময়ের বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা, মানসিকতা, এবং মূল্যবোধের চিত্র ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো একদিকে যেমন ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য ও দ্বন্দ্বের সাথে পরিচিত, তেমনি তারা বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিনিধিও বটে।
চরিত্রের নাম | ভূমিকা | বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|
অনিমেষ দাস | প্রধান চরিত্র | উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান, যিনি পরবর্তীতে নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হন। জটিল, দ্বন্দ্বময় চরিত্র, আদর্শ ও বাস্তবতার সংঘাতে দোদুল্যমান। |
রুণা সেন | অনিমেষের প্রেমিকা | শিক্ষিত, আধুনিকমনা, স্বাধীনচেতা নারী। সামাজিক রূঢ়তা ও পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অনিমেষের রাজনৈতিক জীবনে সহযাত্রী। |
বিনয়ভূষণ চৌধুরী | অনিমেষের বাবা | দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গে ছিলেন সম্পন্ন জমিদার। দেশভাগের পর সব হারিয়ে কলকাতায় উদ্বাস্তু জীবন। পুরনো মূল্যবোধ ও নতুন বাস্তবতার মধ্যে দ্বন্দ্ব। |
মানবেন্দ্র রায় | রাজনৈতিক নেতা | নকশাল আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আদর্শবাদী কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আপসমুখী হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক আদর্শ ও ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে জর্জরিত। |
সুজাতা দাস | অনিমেষের মা | দৃঢ়চেতা, সংসার-কেন্দ্রিক নারী। দেশভাগের ট্রমা ও দারিদ্র্যের মধ্যেও পরিবারকে একসূত্রে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেন। আপাত সাধারণ কিন্তু গভীরে অসাধারণ শক্তি। |
সাগরময় মুখার্জি | প্রতিষ্ঠিত লেখক | কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিনিধি। পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও দ্বন্দ্বের প্রতীক। অনিমেষের মেন্টর ও পরামর্শদাতা। |
দীপঙ্কর সেন | রুণার দাদা | প্রগতিশীল চিন্তাধারার যুবক। আদর্শবাদী রাজনীতি থেকে ক্রমে বাস্তবমুখী রাজনীতিতে প্রবেশ। সমসাময়িক তরুণ প্রজন্মের দ্বিধা ও সংঘাতের প্রতিনিধি। |
সমরেশ মজুমদারের চরিত্র চিত্রণের বিশেষত্ব হল তিনি কোনো চরিত্রকেই শুধু সাদা বা কালো হিসেবে দেখান না। প্রতিটি চরিত্রের মধ্যেই ভালো-মন্দের সমন্বয় ঘটেছে, যা তাদের বাস্তব ও মানবিক করে তুলেছে। তিনি চরিত্রদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আবেগ, দুর্বলতা, এবং শক্তি সবকিছুই খুব সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করেছেন।
আরো জানুন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের নাম
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। রুণা ও সুজাতার মতো চরিত্রগুলো নিজস্ব সত্তা ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে উপস্থিত, যারা সেই সময়ের পরিবর্তনশীল সমাজে নারীর ভূমিকা ও সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে। তারা কেবল পুরুষ চরিত্রদের পরিপূরক নয়, বরং সমান্তরাল কাহিনির বাহক হিসেবে উপন্যাসে উপস্থিত।
সাতকাহন উপন্যাসের বিখ্যাত উক্তি
সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাসে অনেক অর্থপূর্ণ ও চিন্তা উদ্রেককারী উক্তি রয়েছে যা পাঠকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। এই উক্তিগুলো কেবল চরিত্রদের মনোজগৎ প্রকাশ করে না, বরং জীবন, সমাজ, রাজনীতি ও মানবিক সম্পর্ক সম্পর্কে গভীর দার্শনিক চিন্তাও তুলে ধরে। নিচে উপন্যাসের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উক্তি তুলে ধরা হল:
❝
ইতিহাস যারা ভুলে যায়, তারা তাকে আবার বয়ে বেড়ায়। উদ্বাস্তু হওয়া শুধু দেশ হারানো নয়, নিজের ইতিহাস থেকে উৎখাত হওয়া।
— বিনয়ভূষণ চৌধুরী
❝
বিপ্লব শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য নয়, বিপ্লব মানুষের চেতনার জন্য, মনুষ্যত্বের জন্য। যে বিপ্লব মানুষকে মারে, সে বিপ্লব নয়, প্রতিবিপ্লব।
— অনিমেষ দাস
❝
প্রেম এবং বিপ্লব, দুটোই বিশ্বাসের জায়গা থেকে শুরু হয়। সন্দেহ যেখানে শুরু হয়, সেখানেই শেষ হয়ে যায় উভয়ই।
— রুণা সেন
❝
শক্তি এবং ক্ষমতার সংগ্রাম মানুষকে যতটা পরিবর্তন করে, ততটা পরিবর্তন করে না মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়া।
— মানবেন্দ্র রায়
❝
গৃহত্যাগ শুধু বাড়ি ছেড়ে যাওয়া নয়, তা নিজের থেকেও বেরিয়ে যাওয়া। ফেরার পথ ততটাই দুর্গম যতটা নিজের মধ্যে ফিরে আসা।
— সুজাতা দাস
❝
সাহিত্য প্রশ্ন করে, উত্তর দেয় না। উত্তর দেওয়ার ভান করা সাহিত্য শাসকের ভাষা হয়ে ওঠে, মুক্তির নয়।
— সাগরময় মুখার্জি
এই উক্তিগুলো সমরেশ মজুমদারের গভীর সমাজ দর্শন, রাজনৈতিক বোধ, এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় জটিল দার্শনিক চিন্তাকে উপস্থাপন করেছেন, যা পাঠকদের ভাবিয়ে তোলে। উপন্যাসে এই ধরনের উক্তিগুলো কেবল চরিত্রদের ভাবনাই প্রকাশ করে না, বরং সমসাময়িক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশেরও একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয়।
সাতকাহন উপন্যাস সারাংশ
‘সাতকাহন’ উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয় ১৯৪০-এর দশকে, যখন বিনয়ভূষণ চৌধুরী ও তাঁর পরিবার দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় উদ্বাস্তু হিসেবে আসেন। তাঁদের পূর্বের সম্পন্ন জীবন থেকে হঠাৎ করে দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। প্রথম কাহিনিতে বিনয়ভূষণ ও তাঁর স্ত্রী সুজাতার জীবন সংগ্রাম এবং তাঁদের ছেলে অনিমেষের ছেলেবেলা ও কৈশোরের কথা বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় কাহিনিতে কলকাতার কলেজ জীবনে অনিমেষের রাজনীতিতে যোগদান এবং রুণা সেনের সাথে তার পরিচয় ও প্রেমের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই সময়ে ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়, এবং অনিমেষ ও রুণা উভয়েই এই আন্দোলনে যুক্ত হন।
তৃতীয় কাহিনিতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের উত্থান ও পতন, এবং এর মধ্যে অনিমেষ ও রুণার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা দেখা যায়। মানবেন্দ্র রায়ের মতো রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে সেই সময়ের রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও ভাঙন প্রকাশিত হয়েছে।
চতুর্থ ও পঞ্চম কাহিনিতে আন্দোলনের ব্যর্থতার পর অনিমেষের জীবনযাপন, রুণার সাথে সম্পর্কের পরিণতি, এবং পরিবারের সাথে তার সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন দেখানো হয়েছে। এই পর্বে কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহল ও তাদের রাজনৈতিক ভূমিকাও চিত্রিত হয়েছে সাগরময় মুখার্জির মতো চরিত্রের মাধ্যমে।
ষষ্ঠ ও সপ্তম কাহিনিতে সমগ্র উপন্যাসের বিভিন্ন সূত্র একত্রিত হয়ে একটি সমন্বিত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। অনিমেষ ও বিভিন্ন চরিত্রের পরিণতি, তাদের জীবনের ভাঙা-গড়া, এবং পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের নতুন অবস্থান দেখানো হয়েছে। উপন্যাসের শেষে, নতুন প্রজন্ম ও পুরনো প্রজন্মের সংযোগ, আদর্শের পুনর্মূল্যায়ন, এবং জীবনের চক্রাকার গতির একটি আশাবাদী ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
পুরো উপন্যাস জুড়ে সমরেশ মজুমদার দেশভাগ থেকে শুরু করে নকশাল আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময় পর্যন্ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরেছেন। ব্যক্তি চরিত্রদের জীবন, প্রেম, দ্বন্দ্ব, ও আদর্শের মাধ্যমে তিনি বৃহত্তর ইতিহাস ও সমাজের গতিপ্রকৃতি নিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন।
সাতকাহন উপন্যাস দাম ও প্রকাশনা তথ্য
বইয়ের তথ্য:
- শিরোনাম: সাতকাহন
- লেখক: সমরেশ মজুমদার
- প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
- প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৩
- পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩৮৮
- ধরন: সামাজিক-রাজনৈতিক উপন্যাস
- বর্তমান মূল্য: ৪৫০ টাকা (হার্ডকভার), ৩৫০ টাকা (পেপারব্যাক)
কোথায় পাবেন:
- আনন্দ পাবলিশার্স, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা
- দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
- বুকস.কম
- আমাজন.ইন
- ফ্লিপকার্ট
- কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা
- বাংলা একাডেমী বইমেলা, ঢাকা
* বইয়ের দাম বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। সর্বশেষ মূল্য জানতে প্রকাশনা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করুন।
পাঠক সমালোচনা
৬০০+ পাঠক রিভিউ থেকে গড় রেটিং
অমিত চক্রবর্তী
“সমরেশ মজুমদারের সেরা রচনাগুলির মধ্যে ‘সাতকাহন’ অন্যতম। বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব এবং মিলনের এমন সূক্ষ্ম চিত্রায়ণ খুব কম উপন্যাসেই দেখা যায়। অনিমেষ ও রুণার চরিত্র এবং তাদের সম্পর্কের জটিলতা অসাধারণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।”
সুমিতা সেনগুপ্ত
“নকশাল আন্দোলনের সময়কার বাংলার এতটা নিখুঁত চিত্র খুব কম বইতেই পাওয়া যায়। লেখক কেবল রাজনীতিকেই নয়, মানবিক সম্পর্ক, প্রেম, পরিবার সবকিছুকেই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। কিছু জায়গায় কাহিনি একটু দীর্ঘসূত্রী হয়ে গেছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে একটি অসাধারণ উপন্যাস।”
দেবাশিস চৌধুরী
“‘সাতকাহন’ শুধু একটি উপন্যাস নয়, বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অমূল্য দলিল। আমার পিতা নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন, এবং এই উপন্যাসটি পড়ে আমি সেই সময়ের একটি সম্পূর্ণ চিত্র পেয়েছি। চরিত্রগুলোর মানসিক দ্বন্দ্ব এবং তাদের বিকাশ অসাধারণভাবে চিত্রিত হয়েছে।”
উপসংহার
সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এই উপন্যাসে তিনি দক্ষতার সাথে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতাকে একসূত্রে গেঁথেছেন। দেশভাগ থেকে শুরু করে নকশাল আন্দোলন, মধ্যবিত্ত পরিবারের সংগ্রাম, প্রেম, বিরহ, এবং রাজনৈতিক আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে দ্বন্দ্ব – সবকিছুই অসাধারণ নিপুণতায় চিত্রিত হয়েছে।
উপন্যাসের সাতটি আপাত বিচ্ছিন্ন কাহিনি একে অপরের সাথে জটিল সম্পর্কে বাঁধা, যা লেখকের কাহিনি বয়নের অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেয়। প্রতিটি চরিত্র বহুমাত্রিক ও জীবন্ত, তাদের আবেগ, আশা-নিরাশা, এবং দ্বন্দ্ব বাস্তবসম্মত এবং স্পর্শকাতর। বিশেষ করে অনিমেষ, রুণা, এবং বিনয়ভূষণের মতো চরিত্রগুলো বাংলা সাহিত্যে অনন্য স্থান দখল করে নিয়েছে।
সমরেশ মজুমদারের ভাষা ব্যবহার অত্যন্ত সমৃদ্ধ, যা সহজ-সরল হওয়া সত্ত্বেও গভীর ভাবনা ও দর্শনকে ধারণ করে। তিনি চরিত্রদের অন্তর্জগৎ এবং বাহ্যিক পরিবেশ উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়ে চিত্রিত করেছেন, যা উপন্যাসকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য ‘সাতকাহন’ উপন্যাস বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বোঝার এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস। দেশভাগের ট্রমা, উদ্বাস্তু সমস্যা, নকশাল আন্দোলন, এবং সেই সময়ের সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দেয় এই উপন্যাস। একই সাথে, এটি চিরন্তন মানবিক মূল্যবোধ, সম্পর্ক, এবং অস্তিত্বগত প্রশ্নগুলোও উত্থাপন করে, যা সর্বকালের পাঠকদের ভাবিয়ে তোলে।
সবশেষে, ‘সাতকাহন’ উপন্যাস সমরেশ মজুমদারের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্মগুলির একটি এবং বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় যোগদান। সাহিত্যপ্রেমী, ইতিহাস অনুরাগী, এবং সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী যে কোনো পাঠকের জন্য এটি একটি অপরিহার্য পাঠ্য।