চাঁদের পাহাড়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর কীর্তি – বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস
প্রধান চরিত্রসমূহ
শঙ্কর রায়
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। বেহারী থেকে রেলওয়ে কর্মচারীতে পরিণত হওয়া শঙ্কর আফ্রিকায় গিয়ে এক রোমাঞ্চকর অভিযানে জড়িয়ে পড়ে। সাহসী, অভিযাত্রী ও দৃঢ়সংকল্প এই যুবক বাঙালি পাঠকদের প্রিয় একটি কথাসাহিত্যিক চরিত্র।
দিগো
আফ্রিকান দেশীয় লোক, যিনি শঙ্করের শিকারে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তিনি শঙ্করকে আফ্রিকার বন্য পরিবেশে বেঁচে থাকার কৌশল শেখান।
জিম্বো
পর্তুগিজ অভিযাত্রী যিনি শঙ্করকে আফ্রিকার রহস্যময় সোনার সন্ধান দেন। শঙ্করকে তিনি চাঁদের পাহাড়ের রহস্য ও বুনো ঝাউয়ের কথা বলেন।
আলভারেজ
পর্তুগিজ অভিযাত্রী, যিনি চাঁদের পাহাড়ের আগে কাজ করতেন এবং শঙ্করকে বারণ করেছিলেন ওই পাহাড়ে যেতে।
বুনো ঝাউ
উপন্যাসের এক অতিপ্রাকৃতিক চরিত্র, যাকে ভয়ঙ্কর রাতের অন্ধকারে ঘেরা চাঁদের পাহাড়ে দেখা যায়।
উপন্যাস পড়ুন
ভূমিকা
ভারতের বর্ধমানের কাছে ছোট্ট গোপীনাথপুর গ্রামে শঙ্করের জন্ম। সে এক অসাধারণ প্রতিভাবান ছেলে, কিন্তু বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় কলেজে পড়া সম্ভব হয়নি। তার পিতা দারিদ্র্যের কারণে তাকে রেলওয়েতে চাকরি করতে পাঠান। কিন্তু শঙ্করের মনে সর্বদা ঝড় বইত – সে প্রবাসী বাংলা পত্রিকায় লিভিংস্টোন, স্ট্যানলি প্রমুখ অভিযাত্রীদের গল্প পড়ে অনন্ত আফ্রিকার ভৌগলিক বর্ণনা মুগ্ধ হয়ে যেত…
শঙ্করের মনে ছিল অসীম জীবনের পিপাসা। তাই যখন আফ্রিকায় উগান্ডা রেলওয়েতে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখল, তখন সে বিনা দ্বিধায় আবেদন করে বসল। তার মাতৃভূমি ছেড়ে সে চলে গেল উগান্ডার জিঞ্জা শহরে…
সেখান থেকেই শুরু হল তার অভিযান, যা তাকে নিয়ে যাবে আফ্রিকার অজানা অঞ্চলে, রহস্যময় চাঁদের পাহাড়ে, বুনো ঝাউয়ের দেশে, এবং একটি হারিয়ে যাওয়া সোনার খনির সন্ধানে।
প্রথম অধ্যায়
রেলওয়ে কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে শঙ্কর আফ্রিকার উগান্ডা পৌঁছাল। জিঞ্জা শহরে তার কর্মজীবন শুরু হল। সেখানে সে অন্যান্য ভারতীয় কর্মচারীর দেখা পেল। সাহেবদের অধীনে কাজ করতে করতে সে আফ্রিকার জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকল।
রেলপথ সংলগ্ন এলাকাগুলিতে নানা রকম জন্তু-জানোয়ার দেখে সে বিস্মিত হল। এক দুর্ঘটনায় সে প্রাণে বেঁচে গেল, যখন হঠাৎ একটি গণ্ডার রেলপথে এসে তাদের গাড়ির ধাক্কা খেল। এই ঘটনার পর তার ভিতরে আফ্রিকার জন্তু-জানোয়ার সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়তে লাগল।
তারপর একদিন সে জিঞ্জা শহরের এক পর্তুগিজ অভিযাত্রী দিয়েগো আলভারেজের সঙ্গে পরিচিত হল, যিনি চাঁদের পাহাড়ে একটি অভিযানে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। আলভারেজ শঙ্করকে তার সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলেন, এবং শঙ্কর আগ্রহের সঙ্গে তা মেনে নিল। এভাবেই তার আফ্রিকান অভিযান শুরু হল।
দ্বিতীয় অধ্যায়
আলভারেজের সঙ্গে শঙ্কর ঘন অরণ্যের অভিযাত্রায় বেরিয়ে পড়ল। আফ্রিকার জঙ্গলে তারা এক দিগো নামে স্থানীয় আফ্রিকান শিকারিকে গাইড হিসেবে পেল। দিগো ছিল অসাধারণ জঙ্গল কাটিয়ে চলার বিশেষজ্ঞ ও নিপুণ শিকারি।
তাদের অভিযানের পথে একদিন একটি বিশাল জলজ অজগর সাপ আক্রমণ করল। শঙ্কর ও আলভারেজ কঠিন শারীরিক লড়াইয়ের পর সেই ভয়ংকর প্রাণীটিকে পরাস্ত করল। এই ঘটনার পর শঙ্করের সাহস আরও বেড়ে গেল, কিন্তু দিগো তাদের সতর্ক করল যে এরচেয়ে ভয়ংকর বিপদ এখনও বাকি আছে।
তারপর তারা একটি গ্রামে এল যেখানে ইংরেজ বনবিভাগের কর্মচারী জিম্বোর দেখা পাওয়া গেল। জিম্বো তাদের একটি পুরানো ডায়েরি দেখাল, যেখানে একটি অজ্ঞাত সোনার খনির কথা উল্লেখ ছিল। সেই খনিটি ছিল রহস্যময় চাঁদের পাহাড়ের কাছে।
তৃতীয় অধ্যায়
জিম্বোর কাছ থেকে ডায়েরি পাওয়ার পরে শঙ্কর ও আলভারেজ চাঁদের পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। পথে তাদের পাশে একটি বিশাল সিংহ দেখা দিল। আলভারেজ তাকে গুলি করে ঘায়েল করল, কিন্তু শঙ্করের প্রতি সিংহটি আক্রমণের জন্য এগিয়ে এল। একটি জীবন-মরণ সংগ্রামে শঙ্কর নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হল।
তারা এরপর এক ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করল। দিগো সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু আলভারেজ তাকে শান্ত করল। হঠাৎ একটি বেলজিয়ান ট্রেডারের দেখা পাওয়া গেল যিনি বুনো ঝাউয়ের সম্পর্কে তাদের সতর্ক করলেন। বুনো ঝাউ ছিল একটি রহস্যময় প্রাণী, যে নাকি চাঁদের পাহাড়ে বাস করে।
সেই রাত্রে তারা কুয়াশাচ্ছন্ন এলাকায় শিবির স্থাপন করল। রাতের মধ্যে হঠাৎ ঝড় উঠল এবং তাদের তাঁবু উড়ে গেল। ঝড়ের শব্দের মধ্যে একটি অদ্ভুত চিৎকার শুনতে পাওয়া গেল, যা ছিল বুনো ঝাউয়ের। ভয়ে দিগো পালিয়ে গেল।
চতুর্থ অধ্যায়
দিগোকে খুঁজতে গিয়ে তারা আরও বিপদে পড়ল। আলভারেজ ও শঙ্কর পথ হারিয়ে ফেলল। তারা একটি পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে পৌঁছাল, যেখানে আকাশ ছিল স্পষ্ট এবং চাঁদের আলোয় একটি পাহাড় দেখা যাচ্ছিল, যেটি আকারে চাঁদের মতো দেখতে। এটাই ছিল চাঁদের পাহাড়।
তারা পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগল, কিন্তু অগ্রসর হতে গিয়ে হঠাৎ আলভারেজ পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল এবং তার পা মচকে গেল। তিনি শঙ্করকে একাই অগ্রসর হওয়ার জন্য বললেন। শঙ্কর একাই চাঁদের পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগল। পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছে সে একটি বিশাল গুহা দেখতে পেল।
গুহায় প্রবেশ করে সে অবাক হয়ে দেখল সেখানে কেউ যেন তাঁবু টানিয়েছে। সে সাবধানে এগোতে লাগল, হঠাৎ একটি অদ্ভুত আকৃতি তার সামনে এসে দাঁড়াল। এটি ছিল বুনো ঝাউ। শঙ্কর ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
পঞ্চম অধ্যায়
জ্ঞান ফিরে পেয়ে শঙ্কর দেখল যে তাকে একটি গুহায় রাখা হয়েছে। সেখানে তার সামনে একটি ভয়ঙ্কর আকৃতির প্রাণী বসে আছে। শঙ্কর ধীরে ধীরে বুঝতে পারল যে এই প্রাণীটি আসলে একজন মানুষ, যে নিজেকে বুনো ঝাউ হিসেবে ছদ্মবেশ ধারণ করেছে।
এই ব্যক্তি ছিল আসলে পর্তুগিজ অভিযাত্রী জর্জ ম্যানুয়েল, যিনি বহু বছর আগে সোনার খনির সন্ধানে এসেছিলেন এবং এখানেই থেকে গিয়েছিলেন। তিনি শঙ্করকে সোনার খনির স্থান দেখালেন। শঙ্কর তাকে সঙ্গে নিয়ে আলভারেজের কাছে ফিরে গেল।
তিনজন মিলে সোনার খনি থেকে কিছু সোনা সংগ্রহ করে ফেরার উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু ফেরার পথে ফের ঝড় উঠল। এবারে এটি ছিল আরও ভয়ঙ্কর। ঝড়ের মধ্যে ম্যানুয়েল হারিয়ে গেলেন। আলভারেজ ও শঙ্কর মাত্র প্রাণে বেঁচে আফ্রিকার বাইরে পৌঁছাতে সক্ষম হলেন।
শঙ্কর ভারতে ফিরে এসে তার অভিযানের কাহিনী লিখলেন, যা পরবর্তীকালে “চাঁদের পাহাড়” নামে প্রকাশিত হয়।
চাঁদের পাহাড় PDF ডাউনলোড করুন
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অমর উপন্যাসটি আপনার কম্পিউটার, মোবাইল বা ট্যাবলেটে সংরক্ষণ করুন এবং যে কোন সময় পড়তে পারেন।
বইয়ের উল্লেখযোগ্য কিছু বাক্য
“এখন আমি বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীতে এমন কতকগুলি জায়গা আছে যেখানে মানুষের পদচারণা নিষিদ্ধ। সেখানে প্রকৃতি আপনার গোপন রাজ্যে একাকিনী বিরাজ করেন, মানুষের প্রবেশ বরদাশত করেন না।”
– চাঁদের পাহাড়
“মানুষের দুঃসাহস ও সাহস, বাধা-বিপত্তির বিরুদ্ধে তার অদম্য চেষ্টা, দুর্জয় ইচ্ছাশক্তি আর বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা তাকে আফ্রিকার ঘোর অরণ্যের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছে।”
– চাঁদের পাহাড়
“কী আশ্চর্য এই আফ্রিকা মহাদেশ! এখানে সভ্যতার কতটুকুই বা আলো এসে পৌঁছেচে। এখনও এর তিন-চতুর্থাংশ জায়গাই প্রকৃতির রাজ্য, মানুষ নয়, এখানে প্রকৃতির সর্বাধিনায়কত্ব এখনও অক্ষুণ্ণ।”
– চাঁদের পাহাড়
চাঁদের পাহাড়ের ঐতিহ্য
বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসগুলির একটি, যা প্রকাশের ৮৫ বছর পরেও সমান জনপ্রিয়।
২০১৩ সালে কমালেশ্বর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত “চাঁদের পাহাড়” নামে একটি সফল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যেখানে দেব অভিনয় করেছেন শঙ্করের চরিত্রে।
বাংলাদেশ ও ভারতের স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে এই উপন্যাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং বহু প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহসিকতা ও অভিযানের প্রতি অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে।
বাংলা ভাষা ছাড়াও এই উপন্যাস ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠি সহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যা এর জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়।
চাঁদের পাহাড় – গল্পের সাধারণ পরিচয়
চাঁদের পাহাড় হল ১৯৩৭ সালে লিখিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। এটি হল শঙ্কর রায় নামে একজন যুবক বাঙালির আফ্রিকার অভিযানের গল্প। সেখানে সে এক মৃত পর্তুগিজ অভিযাত্রীর ডায়েরি পায়, যাতে এক রহস্যময় চাঁদের পাহাড়ে একটি সোনার খনির সন্ধানের কথা লেখা ছিল।
শঙ্কর এই সোনার খনির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে এবং আফ্রিকার বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হয়। সে সিংহ, নদীর ঘড়িয়াল, বিষাক্ত সাপ এবং নরখাদক জন-জাতির হাত থেকে কৌশলে বেঁচে যায়। অবশেষে সে চাঁদের পাহাড়ে পৌঁছে এবং রহস্যময় বুনো ঝাউয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়। বহু কষ্টে খনির সন্ধান পেয়ে শঙ্কর ফিরে আসে দেশে, এক অবিস্মরণীয় অভিযানের স্মৃতি নিয়ে।
এই উপন্যাসে বিভূতিভূষণ অসাধারণ ভাবে আফ্রিকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, জন্তু-জানোয়ার এবং সাহসিকতার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি নিজে আফ্রিকায় না গিয়েও তথ্যের সঠিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রেখে এমন আকর্ষণীয় একটি উপন্যাস লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন যা আজও বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
বইয়ের মূল বিষয়বস্তু:
- সাহস ও অভিযানের প্রতি আকর্ষণ
- প্রকৃতির শক্তি ও মহিমা
- অজানা জায়গার রহস্য উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষা
- মানবিক সীমাবদ্ধতা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি
- বাঙালি চরিত্রের সাহসিকতা ও অভিযানের প্রতি অনুরাগ