বাউল গানের লিরিক্স: আধ্যাত্মিকতার সুর
সূচিপত্র
ভূমিকা
বাউল গান বাংলার লোকসংগীতের একটি অমূল্য ধারা। এই গানগুলি শুধুমাত্র সুরের জাদুতেই মুগ্ধ করে না, বরং গভীর আধ্যাত্মিক ভাবনার প্রকাশ ঘটায়। বাউল ফকিরদের এই গানে রয়েছে জীবনের গূঢ় রহস্যের সন্ধান, প্রেমের অনুভূতি এবং মানবতার জয়গান। এই প্রবন্ধে আমরা বিখ্যাত বাউল গানের লিরিক্স নিয়ে আলোচনা করব।
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
রচয়িতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটি বাউল ধারার প্রভাবে রচিত। এতে মানুষের অন্তরে বিরাজমান পরমসত্তার কথা বলা হয়েছে।
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে
আছে সে নয়নতারায়
আছে সে নয়নতারায়
আলোকধারায়
তাই না হারায়
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক-পানে,
প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
আমি তার মুখের কথা শুনব বলে গেলাম কোথা
আমি তার মুখের কথা শুনব বলে গেলাম কোথা
শোনা হল না, হল না
আজ ফিরে এসে নিজের দেশে
ফিরে এসে নিজের দেশে
এই-যে শুনি
শুনি তাহার বাণী আপন গানে
প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।
কে তোরা খুঁজিস তারে,কাঙাল-বেশে দ্বারে দ্বারে
কে তোরা খুঁজিস তারে,কাঙাল-বেশে দ্বারে দ্বারে
দেখা মেলে না মেলে না
তোরা আয় রে ধেয়ে দেখ্ রে চেয়ে
আয় রে ধেয়ে দেখ্ রে চেয়ে
আমার বুকে
ওরে দেখ্ রে আমার দুই নয়ানে,
প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
রচয়িতা: লালন ফকির
লালন ফকিরের এই বিখ্যাত গানটি আত্মা ও দেহের সম্পর্ক নিয়ে গভীর দার্শনিক ভাবনা প্রকাশ করে।
কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায়।।আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।।
কপালের ফ্যার নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার।
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।।
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে।
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।।
এমন মানুষ কোথায় পাব
রচয়িতা: গগন হরকরা
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে,
আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে।লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী,
পেলে মন হত খুশী, দিবা নিশি দেখিতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে, নিভাই কেমন করে,
মরি হায়, হায় রে-
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে, নিভাই কেমন করে,
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে, বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
দেখ না তোরা হৃদয়ে চিরে, দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগত্ খুশি,
হেরিলে জুড়ায় আঁখি, সামান্যে কি দেখতে পারে তারে?
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে,
মরি হায়, হায় রে-
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে,
ও সে না জানি কি কুহক জানে, না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষে মন চুরি করে, ওরে অলক্ষে মন চুরি করে
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে-
তাইতো মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথা না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায়, হায় রে-
ও তার বসত কোথা না জেনে তায় গগন ভেবে মরে।
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস, মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস
কৃপা করি বলে দে রে, আমার সুহৃদ হয়ে বলে দে রে,
ব্যথার ব্যথিত হয়ে বলে দে রে,
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে।
মিলন হবে কত দিনে
রচয়িতা: লালন ফকির
আমার মনের মানুষের সনে।।চাতক প্রায় অহর্নিশি
চেয়ে আছে কালো শশী।
হব বলে চরণদাসী
তা হয় না কপাল গুণে।।
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
লুকালে না পায় অন্বেষণ।
কালারে হারায়ে তেমন
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।।
ঐ রূপ যখন স্মরণ হয়
থাকে না লোকলজ্জার ভয়।
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
ও প্রেম যে করে সেই জানে।।
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে,
আসমান হইল টুটা টুটা জমিন হইল ফাটা
মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিব তোর কেডা
আল্লাহ মেঘ দে আল্লাহ মেঘ দে
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে পানি
ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে।।ফাইটা ফাইটা রইছৈ যত খালা বিলা নদী
পানির লাইগা কাইন্দা ফিরে পঙ্খী জলদি
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে পানি
ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে।।
কপোত কপোতি কাদে কূপেতে বসিয়া
শুকনা ফুরের কলি পড়ে ঝড়িয়া ঝড়িয়া
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে পানি
ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে।।
বাউল দর্শন ও লিরিক্সের গভীরতা
বাউল গানের লিরিক্সগুলো শুধুমাত্র কাব্য নয়, এগুলো গভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ। এই গানগুলোতে রয়েছে:
আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু
বাউল গানে প্রধানত মানুষের অন্তরে বিরাজমান পরমসত্তার সন্ধানের কথা বলা হয়েছে। “মনের মানুষ” এই পরমসত্তারই অপর নাম।
প্রেম ও ভক্তি
বাউল গানে প্রেম ও ভক্তির মিশ্রণ দেখা যায়। এখানে প্রেম শুধু পার্থিব নয়, বরং আধ্যাত্মিক প্রেমের কথা বলা হয়েছে।
মানব প্রকৃতি
বাউল কবিরা মানুষের দেহ ও মনের জটিল সম্পর্ক নিয়ে গভীর ভাবনা প্রকাশ করেছেন। “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” এর উপমায় এই বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
আরো জানুন: সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে লিরিক্স
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
বাউল গানের লিরিক্স বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। এই গানগুলো:
- ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে মানবতার জয়গান গেয়েছে
- সামাজিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে মানুষের মর্যাদা তুলে ধরেছে
- আধ্যাত্মিক সাধনার সহজ পথ দেখিয়েছে
- বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে
উপসংহার
বাউল গানের লিরিক্স আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই গানগুলি কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং জীবনের গভীর সত্যের সন্ধান দেয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে লালন, গগন হরকরাসহ অনেক মহৎ কবি ও সাধক এই ধারায় অবদান রেখেছেন।
আজকের যুগেও বাউল গানের লিরিক্স আমাদের মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ দেখায়। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব।