ভাই কী মধুর একটা কবিতা! বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই কবিতা শুনলেই মন ভরে যায় এক অসাধারণ আবেগে। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর এই অমর কবিতা “কাজলা দিদি” বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। আজকে আমরা এই কবিতার সম্পূর্ণ লিরিক্স এবং ইংরেজি ও হিন্দি অনুবাদ নিয়ে হাজির হয়েছি।
কাজলা দিদি – সম্পূর্ণ কবিতা
কবি: যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে,
থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই,
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন
দিদি বলে ডাকি তখন,
ও-ঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি, তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে
আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন ক’রে রবে?
আমিও নাই- দিদিও নাই- কেমন মজা হবে!
ভূঁই-চাঁপাতে ভরে গেছে শিউলী গাছের তল,
মাড়াস নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল |
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে
বুলবুলিটা লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা ছিঁড়তে গিয়ে ফল,
দিদি যখন শুনবে এসে বলবি কি মা বল্ |
বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর তলে পুকুর পাড়ে
ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতো জেগে রই,—
রাত্রি হোল মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?
English Translation – Kajla Didi
By: Jatindramohan Bagchi
Above the bamboo grove, the moon has risen there,
O mother, where is my sweet-talking Kajla sister?
By the pond beneath the lemon tree,
Fireflies glow in clusters free,
The flower’s fragrance keeps me awake, alone I stay,
O mother, close to your lap, where is Kajla sister today?
Since that day, why don’t you call sister anymore;
Why do you cover your face with your veil when she’s mentioned for sure?
When I come to eat my meal
And call for sister with appeal,
Why doesn’t sister come from that room anymore?
When I call, why do you stay silent at the door?
Tell me mother, where has sister gone, when will she return again?
Tomorrow in my new room, my doll’s wedding will begin!
If like sister, playing tricks,
I too hide away and fix,
How will you stay alone in the room then?
With neither me nor sister – what fun will remain!
The ground is covered with fallen jasmine flowers white,
Don’t step on them, mother, when you fetch water in the night.
In the gaps of pomegranate tree
The nightingale hides, can’t you see,
Don’t chase it away, mother, while picking fruit so bright,
When sister comes and hears, what will you say, tell me right?
Above the bamboo grove, the moon has risen there,
At such a time, O mother, where is my Kajla sister?
Beneath the lemon tree by the pond’s side
Crickets call from bushes far and wide,
The flower’s fragrance keeps me awake, that’s why I stay aware,—
Night has fallen, mother, where is my Kajla sister?
Hindi Translation – काजला दीदी
कवि: जतींद्रमोहन बागची
बांस के बगीचे के ऊपर चांद निकला है वहां,
मां मेरी मीठी बोली काजला दीदी कहां?
तालाब के किनारे नींबू के नीचे,
गुच्छों में जुगनू जलते हैं बीचे,
फूलों की खुशबू से नींद नहीं आती, अकेला जागता हूं यहां,
मां तेरी गोद के पास काजला दीदी कहां?
उस दिन से क्यों मां दीदी को नहीं बुलाती;
दीदी की बात पर आंचल से मुंह क्यों ढकाती?
जब खाना खाने आता हूं
दीदी को बुलाता हूं
उस कमरे से क्यों मां दीदी नहीं आती?
मैं बुलाता हूं, तुम चुप क्यों रह जाती?
बोलो मां दीदी कहां गई, कब वापस आएगी?
कल मेरे नए घर में गुड़िया की शादी होगी!
दीदी की तरह धोखा देकर
अगर मैं भी छुप जाऊं जाकर
तुम अकेले कमरे में कैसे रहोगी?
न मैं हूं न दीदी है – कैसा मजा आएगी!
भूंई-चांपा से भर गया है शिउली के पेड़ के नीचे,
मत रौंदना मां तालाब से पानी लाते वक्त बीचे।
अनार के पेड़ की झिरी में
बुलबुल छुपी बैठी वहीं
उड़ाना मत मां फल तोड़ते समय उसे खींचे,
दीदी जब सुनेगी आकर क्या कहेगी मां सीचे।
बांस के बगीचे के ऊपर चांद निकला है वहां,
ऐसे समय मां मेरी काजला दीदी कहां?
नींबू के नीचे तालाब के किनारे
झींगुर बोलते हैं झाड़ियों में सारे,
फूलों की खुशबू से नींद नहीं आती, इसलिए जागता हूं यहां,—
रात हो गई मां, मेरी काजला दीदी कहां?
কবিতার পটভূমি ও তাৎপর্য
উফ! কী গভীর আবেগ! এই কবিতায় একটি ছোট্ট শিশুর মুখ দিয়ে যতীন্দ্রমোহন বাগচী মৃত্যুর করুণ বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। আমাদের সাহিত্য জগতে এমন হৃদয়স্পর্শী কবিতা বিরল।
কবিতার মূল বিষয়বস্তু:
- শিশুর নিষ্পাপ প্রশ্ন: দিদি কোথায় গেছে?
- মৃত্যুর বাস্তবতা: যা শিশু বুঝতে পারে না
- মায়ের নীরবতা: কষ্ট লুকানোর চেষ্টা
- প্রকৃতির চিত্র: চাঁদ, জোনাক, ফুলের গন্ধ
কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী
জীবনী সংক্ষেপ:
- জন্ম: ১৮৭৮ সাল, কলকাতা
- মৃত্যু: ১৯৪৮ সাল
- পেশা: কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার
- বিখ্যাত রচনা: কাজলা দিদি, শিশু কবিতা
- বিশেষত্ব: শিশুতোষ কবিতার অগ্রদূত
কবিতার চরিত্র বিশ্লেষণ
শিশু চরিত্র:
কবিতার মূল চরিত্র একটি নিষ্পাপ শিশু যে তার বোন ‘কাজলা দিদি’র অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করছে। শিশুটি মৃত্যুর ধারণা বুঝতে পারে না।
মা চরিত্র:
মা চরিত্রটি নীরব, কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছেন। আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকা তার গভীর দুঃখের প্রতীক।
কাজলা দিদি:
অনুপস্থিত কিন্তু কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার মৃত্যু পুরো পরিবারে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
প্রকৃতির ব্যবহার
কবি প্রকৃতির নানা উপাদান ব্যবহার করে কবিতায় গভীরতা এনেছেন:
প্রকৃতির উপাদান | প্রতীকী অর্থ | কবিতায় ভূমিকা |
---|---|---|
চাঁদ | শান্তি ও নিস্তব্ধতা | রাতের পরিবেশ সৃষ্টি |
জোনাক | আশা ও আলো | অন্ধকারে আলোর প্রতীক |
ফুলের গন্ধ | স্মৃতি ও কষ্ট | ঘুম না আসার কারণ |
বাঁশবাগান | গ্রাম্য পরিবেশ | পটভূমি তৈরি |
পুকুর | জীবনের প্রবাহ | দৈনন্দিন জীবনের অংশ |
কবিতার ভাষা ও ছন্দ
কী মধুর ভাষা! যতীন্দ্রমোহন বাগচী সহজ-সরল বাংলা ভাষায় এই কবিতা রচনা করেছেন। শিশুর মুখের ভাষা ব্যবহার করে তিনি গভীর দর্শন প্রকাশ করেছেন।
ছন্দের বৈশিষ্ট্য:
- মাত্রাবৃত্ত ছন্দ: ১৪ মাত্রার পংক্তি
- অন্ত্যমিল: প্রতি স্তবকে মিল রয়েছে
- ধ্বনিময়তা: পড়তে মধুর লাগে
- গতি: ধীর ও করুণ
সাহিত্যিক গুরুত্ব
বাংলা সাহিত্যে স্থান:
- শিশুসাহিত্যের মাইলফলক: প্রথম সারির শিশুতোষ কবিতা
- আবেগের গভীরতা: সরল ভাষায় গভীর অনুভূতি
- সর্বজনীন আবেদন: সব বয়সের পাঠকের কাছে প্রিয়
- সাংস্কৃতিক প্রভাব: বাঙালি সংস্কৃতির অংশ
আবৃত্তি ও সুরারোপ
এই কবিতাটি বাংলা আবৃত্তি জগতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। অনেক বিখ্যাত শিল্পী এটি আবৃত্তি করেছেন এবং সুরারোপ করেছেন।
বিখ্যাত আবৃত্তিকারী:
- কাজী সব্যসাচী
- পূর্ণেন্দু পত্রী
- উৎপল দত্ত
- সুমিত্রা সেন
শিক্ষামূলক দিক
এই কবিতা থেকে আমরা যা শিখতে পারি:
- পারিবারিক বন্ধন: ভাইবোনের ভালোবাসা
- মৃত্যু চেতনা: জীবনের অনিবার্য সত্য
- শিশুমন: নিষ্পাপতা ও কৌতূহল
- প্রকৃতিপ্রেম: পরিবেশের সাথে সম্পর্ক
- ভাষার সৌন্দর্য: সহজ ভাষায় গভীর অর্থ
আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
আজকের যুগেও এই কবিতার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। শিশুদের মানসিক বিকাশে, পারিবারিক সম্পর্ক বোঝাতে এবং সাহিত্যরুচি গড়তে এই কবিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাহিত্য সমালোচক মতামত: “কাজলা দিদি কবিতাটি শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি অনন্য সৃষ্টি। এতে শিশুর নিষ্পাপ প্রশ্নের মাধ্যমে জীবনের গভীর সত্য উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারে এটি একটি অমূল্য সম্পদ।”
– প্রফেসর ড. অনিল চন্দ্র, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক
উপসংহার
সত্যিই কী অসাধারণ একটি কবিতা! বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই কবিতা শুধু একটি শিশুতোষ রচনা নয়, এটি জীবনের গভীর সত্য ও মানবিক আবেগের অপূর্ব প্রকাশ। যতীন্দ্রমোহন বাগচী সহজ ভাষায় যে গভীরতা সৃষ্টি করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
ফ্রেম টু ফ্রেম পাল্লা দিয়ে এই কবিতার প্রতিটি পংক্তি আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। একটি শিশুর নিষ্পাপ প্রশ্নের মাধ্যমে কবি মৃত্যু, বিরহ ও পারিবারিক বন্ধনের যে চিত্র এঁকেছেন, তা আজও আমাদের মুগ্ধ করে।
এই কবিতা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে চিরকাল প্রিয় থাকবে। ইংরেজি ও হিন্দি অনুবাদের মাধ্যমে এর সৌন্দর্য অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের কাছেও পৌঁছে যাবে।
সাহিত্যিক মূল্যায়ন:
“কাজলা দিদি” কবিতাটি বাংলা শিশুসাহিত্যের একটি চিরকালীন সম্পদ। এর সরল ভাষা, গভীর আবেগ ও শাশ্বত বিষয়বস্তু এটিকে অমর করে রেখেছে।
ব্যক্তিগত রেটিং: ১০/১০
ধন্যবাদ যতীন্দ্রমোহন বাগচী এমন একটি অনবদ্য কবিতা উপহার দেওয়ার জন্য। আমাদের সাহিত্য এভাবেই সমৃদ্ধ হোক!